মেয়েদের মাঝে যে সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে গম্ভীর এবং এতক্ষণ পর্যন্ত যে একটাও কথা বলে নি এবারে মুখ খুলল, বলল, তোমরা খালি নিজেরা কথা বলছ। আমাদের যে নূতন একটা রুমমেট এসেছে তার নাম টাম জিজ্ঞেস করবে না?
গোলগাল মেয়েটা বলল, হঁ, ঠিকই বলেছিস। তোমার নাম কী ভাই?
আমার নাম নিতু। তোমাদের নাম?
চশমা পরা মেয়েটা বলল, আমার নাম রেবেকা।
গোলগাল মেয়েটা হি হি করে হেসে বলল, আমরা নামটা আরো শর্ট করে নিয়েছি। আমরা ডাকি বেকা!
আর তোমার নাম?
মিতুল।
চশমা পরা মেয়েটি যার নাম রেবেকা এবং যার নাম শর্ট করে বেকা করে ফেলা হয়েছে এবারে মাথা নেড়ে বলল, আর মিতুলের নামটা অবিশ্যি শর্ট করি নাই আরেকটু বড় করেছি! মিতুল হচ্ছে তুলতুলে মিতুল!
রুনু (কিংবা কে জানে ঝুনুও হতে পারে) বলল, কেন তুলতুলে মিতুল বুঝেছ তো? কারণ সে নাদুস নুদুস গোলগাল তুলতুল।
গোলগাল চেহারার তুলতুলে মিতুল, চোখ পাকিয়ে বলল, দেব একটা দাবড়ানি। কিন্তু বলা পর্যন্তই মুখ দেখে মনে হয় তার নিজের নামটা সে পছন্দই করেছে।
মেয়েগুলির মাঝে যে সবচেয়ে ছোট এবং এদের মাঝে যে সবচেয়ে কম কথা বলে সে গম্ভীর গলায় বলল, এই দুইজনের নাম তো বলেছি—রুনু আর ঝুনু। আর আমি হচ্ছি তানিয়া।
মিতুল আবার হি হি করে হেসে বলল, কি নিয়া?
তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, ফাজলেমি করবি না।
মিতুল চোখ বড় বড় করে অভিনয় করার মতো করে বলল, চা-নিয়া? উহুঁ তানিয়া!
তানিয়া মুখ আরো গম্ভীর করে বলল, দ্যাখ নাম নিয়ে কখনো ফাজলেমি করবি না। মানুষের নাম খুব ইম্পর্ট্যান্ট। কবি রবীন্দ্রনাথের নাম যদি রবীন্দ্রনাথ না হয়ে মাহতাব মিয়া হতো তাহলে কি কখনো কবিতা লিখতে পারতেন?
চশমা পরা রেবেকা বলল, ভাই তুমি তো বুঝতেই পারছ আমাদের মাঝে তানিয়া হচ্ছে মাস্টার মশাই। চল্লিশ বছরের একটা মানুষ ওই ছোট শরীরের মাঝে আটকা পড়ে আছে।
উহুঁ চল্লিশ না। গোলগাল মিতুল মাথা নেড়ে বলল, ফিফটি ফাইভ।
তানিয়া আরো গম্ভীর হয়ে বলল, দ্যাখ, তোরা বেশি ফাজলেমি শুরু করেছিস।
রুনু (কিংবা ঝুনু হেসে বলল, আমাদের তানিয়া সব সময় তোমাকে উপদেশ দিবে।
ঝুনু কিংবা রুন) বলল, যে কোনো বিষয়ে উপদেশ। কেমন করে কথা বলতে হয়, কেমন করে নাক ঝাড়তে হয়, কেমন করে কান চুলকাতে হয়—
তানিয়া আবার বলল, বাজে কথা বলবি না ঝুনু। তোরা বড় বেশি কথা বলিস।
চশমাপরা রেবেকা বলল, আসলে আমরা বেশি কথা বলি না। আমাদের এই বেডটা খালি ছিল তো তাই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম কে মা কে রুমমেট হিসাবে আসে! তোমাকে দেখে ভয় কেটে গেছে তো তাই সবাই বকবক করছে।
নিতু একটু অবাক হয়ে বলল, আমাকে দেখে ভয় কেটে গেছে? আমার সম্পর্কে তো কিছুই জান না!
জান না কেন। তোমার মা মারা গেছেন তাই তোমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। এইটুকুন জানলেই তো সব জানা হয়ে যায়। তুমি তো আমাদের মতোই একজন।
এখানে তোমরা সবাই এরকম?
হ্যাঁ। হয় বাবা মা ডিভোর্স না হলে বাবা-মা মারা গেছেন, তা না হলে মা মারা গেছেন।
নিতু একটু অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাল, কত অল্প বয়সের সবাই এর মাঝে সবাই কত বড় বিপদের মাঝে দিয়ে গিয়েছে!
মিতুল নিতুর গায়ে হাত দিয়ে বলল, তুমি মন খারাপ করো না। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগবে, তারপর দেখবে অভ্যাস হয়ে গেছে।
নিতু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন বাইরে থেকে একটা কর্কশ হুইসিলের শব্দ শুনতে পেল। রেবেকা লাফিয়ে উঠে বলল, বাঁশি বেজে গেছে! তাড়াতাড়ি।
কীসের বাঁশি?
নাস্তা করে খেলার মাঠে যাওয়ার বাঁশি! দেরি যেন না হয় বিপদ হয়ে যাবে। তাহলে।
অন্য সবার সাথে নিতুও ছোটাছুটি করে রেডি হতে শুরু করে, বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ে পদে পদে বিপদ, সেটা সে এতক্ষণে বেশ ভালো করেই বুঝে গেছে।
০৩. ললিপপ
দশটা বাজার কয়েক মিনিট আগে ঘরের বাতি নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়ল। ঘরে সুমসাম নীরবতা, মনে হয় বুঝি কেউ নেই। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে একটু নাড়াচাড়া করে, নিশ্বাসের শব্দ হয়, কেউ কেউ ঘুমের মাঝে একটা দুইটা কথা বলে। কিন্তু যখন কেউ ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে তখন তারা টু শব্দটাও করে না, তাই ঘরে একটু শব্দও নেই।
আলো নিভিয়ে দেয়ার পর ঘরের ভিতরে প্রথমে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও আস্তে আস্তে চোখে অন্ধকার সয়ে এসে এখন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছয়টা বাক্সের মতন ঘরের মাঝে ছয়টা মশারি টানানো এবং তার ভিতরে ছয়টি মেয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। নিতু শুয়ে শুয়ে শুনতে পায় বারান্দা দিয়ে প্রথমে গুম গুম শব্দ করে একজন হেঁটে গেল, নিশ্চয়ই খোরাসানী ম্যাডাম। এরপর খ্যাস খাস শব্দ করে সেন্ডেল ঘষে আরেকজন, সম্ভবত হোস্টেল সুপারিনটেন্ড যাকে দেখলে মনে হয় তার শরীরের মাঝে নল ঢুকিয়ে কেউ একজন তাকে চুষে খেয়ে নিয়ে ছিবড়েটা ফেলে গেছে। নিতু বিছানায় শুয়ে কয়েকবার এপাশ ওপাশ করল এবং ঘুমানোর চেষ্টা করল তারপর বুঝতে পারল আসলে সে ঘুমাতে পারবে না। নতুন জায়গায় সবাই ঘুমাতে দেরি হয় কিন্তু নিতর সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সে যখন খুব ছোট তখন তার জন্মদিনে তার মা তাকে একটা টেডি বিয়ার উপহার দিয়েছিলেন, পেট-মোটা তুলতুলে নরম হালকা বাদামি রংয়ের টেডি বিয়ারটাকে বুকে জড়িয়ে সে সাথে সাথে তার নাম দিয়েছিল ভোটকা। মিয়া। নিতু কখনো তার এই ভোটকা মিয়াকে কাছ ছাড়া করে নি। রাতের বেলা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে, তার সাথে কথা বলেছে। এই প্রথম আজ রাতে তার সাথে ভোটকা মিয়া নেই, নিতুর মনে হচ্ছে তার নিজের শরীরের একটা অংশ হারিয়ে গেছে। ভোটকা মিয়া ছাড়া সে ঘুমাবে কেমন করে? নিতু তখন হঠাৎ করে তার বিছানায় উঠে বসল। কী করতে হবে সে বুঝতে পেরেছে, ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনতে হবে।