বল।
বেগম জোহরা কামালের সব কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছি আমরা।
কী বললে? শান্তা আপা চিৎকার করে বললেন, কী বললে?
হ্যাঁ আপা। আপনার ঘরেই ছিল। ঐ সিক্রেট ধাপটার মাঝে! সব কিছু আছে। স্কুলের দলিল। স্কুলের পরিকল্পনা, সব।
কী আশ্চর্য! শান্তা আপা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালেন, বললেন, তোমরা খুঁজে পেয়ে গেছ! তার মানে কী জান? তার মানে হচ্ছে আর কেউ কখনো তোমাদের জ্বালাতন করতে পারবে না!
না আপা, পারবে না।
কী আশ্চর্য, আমি সারা দুনিয়া চষে ফেলছি, আর তোমরা কী না—
আপা।
কী হল?
চলেন স্কুলে যাই। সব মেয়েরা কী ভয়ে ভয়ে আছে, তাদেরকে গিয়ে সব কিছু বলি। সাহস দিই।
চল। হেঁটে যেতে পারবে তো?
কী বলেন আপা, আমরা এর মাঝে কী কী করেছি শুনলে আপনার হার্টফেল হয়ে যাবে।
শান্তা আপা মাথা নাড়লেন, বললেন, মনে হচ্ছে তোমরা ঠিকই বলছ, সত্যি হার্টফেল হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই ছোট দলটি রওনা দিল। প্রথমে রিক্সায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা দুই মাস্তান। তার পিছনে ছয়জনের ছোট দল এবং সবার শেষে শান্তা আপা। কাঁটা রাইফেল থেকে বুলেট বের করে নেয়া হয়েছে এবং সেই একেকবার একেকজন ঘাড়ে করে নিচ্ছে। স্কুলের কাছাকাছি এসে ওরা ছোট খাট শ্লোগান দেয়া শুরু করল, হায় হায় এ কী হল? শান্তা আপা ফিরে এল কিংবা গুণ্ডা মাস্তান কান্দে—দড়ি দিয়া বান্ধে) ইলেকট্রিক শক খাওয়া খাড়া খাড়া চুল দাড়ি ওয়ালা দারোয়ান প্রথমে স্কুলের গেট খুলতে দারোয়ান রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু মেয়েদের হাতে কাঁটা রাইফেল দেখে আর আপত্তি করল না।
স্কুলের সীমানার ভিতরে ঢুকে, হবে হবে জয়, নাই ভয় নাই ভয় গাইতে গাইতে দলটি খোরাসানী ম্যাডামের বাসার দিকে যেতে থাকে। তাদের গান শুনে হোস্টেলের সব মেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। গেটে তালা লাগানো না থাকলে নিশ্চয়ই সবাই এতক্ষণ ছুটে আসত।
খোরাসানী ম্যাডামের বাসায় যাবার আগেই দেখা গেল সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, কপালে কাছে একটা অংশ ফুলে গিয়ে বাম চোখটা প্রায় বুজে গিয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বেকায়দা ভাবে সে একটা আছাড় খেয়েছে, ঘরের মেঝেতে তেল ঢেলে রাখার কারণেই হয়ে সম্ভবত কিন্তু এখন সেটা জানার কোনো উপায় নাই। খোরাসানী ম্যাডাম এই ছোট দলটি দেখে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল।
শান্তা আপা এগিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি তো আমাকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন এই স্কুলে তো আমার আসা উচিত না। তবু চলে এলাম। তিনটা খুব জরুরি কাজ পড়ে গেল কি না।
খোরাসানী ম্যাডাম কোনো কথা না বলে রক্তচক্ষু করে শান্তা আপার দিকে তাকিয়ে রইল। শান্তা আপা হাসি হাসি মুখে বললেন, প্রথম কাজটা হচ্ছে একটা টেলিফোন করতে হবে পুলিশের কাছে। রাস্তা থেকে দুইটা মাস্তান ধরে এনেছি, অস্ত্রপাতি সহ। আসলে আপনার স্কুলের মেয়েরাই ধরেছে আমি শুধু সাথে ছিলাম। গুণ্ডা বদমাইস বাইরে থাকা ঠিক না।
আর দুই নম্বর কাজটা হচ্ছে একটা রিসিট নিয়ে। এই মাস্তান দুইজন নাকি আপনার কাছ থেকে এক হাজার টাকা এডভান্স নিয়েছে কিন্তু কোনো রিসিট দেয় নাই। কী অন্যায়। কী অন্যায়! রিসিট না দিয়ে এক হাজার টাকা নিয়ে গেল? এক্ষুনি একটা রিসিট লিখিয়ে নেন।
তিন নম্বর কাজটা আসলে ঠিক কাজ না– শান্তা আপা ইতস্তত করে বললেন, তিন নম্বর কাজটা একটা প্রশ্ন। আপনি কী মোটা চালের ভাত খেতে পারেন?
খোরাসানী ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, কী?
আপনি কি মোটা চালের ভাত খেতে পারেন? শুনেছি জেলখানায় নাকি শুধু মোটা চালের ভাত দেয়। আমরা বেগম জোহরা কামালের ফাইলটা খুঁজে পেয়েছি কি না—
শান্তা আপা কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ খোরাসানী ম্যাডাম আঁ আঁ শব্দ করে, তবে রে শয়তানী বলে চিৎকার করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে একটা চলন্ত ট্রাকের মতো শান্তা আপার দিকে ছুটে এল, দরজার কাছাকাছি এসে বাঘ যেভাবে লাফ দেয় সেভাবে শান্তা আপার ওপর লাফিয়ে পড়ল। শান্তা আপা মনে হয় প্রস্তুত ছিলেন, শুধু বাম দিকে একটু সরে গেলেন আর খোরাসানী ম্যাডাম প্রচণ্ড শব্দ করে ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। সেই অবস্থায় মাথাটা একবার তুলে শেষে একটা হুংকার দিয়ে নেতিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
রিক্সাওয়ালা এগিয়ে এসে বলল, ইয়া মাবুদ! এইটা তো দশমনী লাশ! কোরবানীর গরু হলে ষাট হাজার টাকার এক পয়সা কমে কেউ গাবতলীর বাজার থেকে কিনতে পারত না।
এরকম অমার্জিত রূট একটা কথায় কিছুতেই ছাত্রীদের সামনে হাসবেন না ঠিক করেও শান্তা আপা হঠাৎ হি হি করে হেসে ফেললেন -তখন হাসতে হাসতে অন্য সবার যা একটা অবস্থা হল সে আর বলার মতো নয়।
১৩. শেষ কথা
বুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের নূতন নাম শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বিদ্যায়তন। শান্তা আপা হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্বের সাথে সাথে আপাতত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন। নূতন একজন প্রিন্সিপাল খোঁজা হচ্ছে যদিও ছাত্রীদের একান্ত ইচ্ছা শান্তা আপাই শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্বে থেকে যান।
বেগম জোহরা কামাল যেভাবে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবে স্কুলটাকে নূতন করে দাঁড় করানো হচ্ছে, স্নেহ মমতা আর ভালবাসা দিয়ে। কাসেম পর্যন্ত চাঁদাবাজী ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে গেছে, আজকাল তাকে অবিশ্যি কেউ কাসেম ডাকে না, ডাকে কুসুম। শান্তা আপার দেয়া নাম। অন্যে মেয়েরাও যা মিষ্টি স্বভাবের হয়েছে সেটা লিখে বোঝানো যাবে না। (তবে সবাই যে সবসময় মিষ্টি সেই গ্যারান্টি অবিশ্যি দেয়া যাচ্ছে না। এই কয়েকদিন আগে মাঝ রাতে যখন–থাক, সেই বৃত্তান্ত এখন টেনে আনা ঠিক হবে না।)