গাড়ির বনেটে বসে থাকা মাস্তান দুটি লাফিয়ে উঠে একজন আরেকজনকে প্রায় জড়িয়ে ধরল। কাচু বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, ওইটা কীসের শব্দ?
পা-পা- পাখি নিশ্চয়ই।
পাখি কি মা-মা মানুষের মতো ডাকে?
ওস্তাদ ভয় পাওয়া গলায় বলল, তা হলে কী?
রা-রা-রাত্রে বেলা নাম নিতে চাই না ওস্তাদ।
ঠিক এ রকম সময় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রেবেকা ছোট একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল, গাড়ির দরজায় লেগে সেটা তীক্ষ্ম একটা ধাতব শব্দ করে উঠল আর সাথে সাথে মানুষ দুইজন আবার ভীষণভাবে চমকে উঠে। কাচু শুকনো গলায় বলল, এইটা কীসের শব্দ ওস্তাদ? মনে হল কেউ ঢিল মেরেছে?
ঢিল? ঢিল এখানে কে মারবে?
তাহলে? কাচু কাঁদো গলায় বলল, এখানে কী হচ্ছে ওস্তাদ?
যখন মাস্তান দুজনকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে ঠিক তখনই দুই পাশ থেকে নিতু আর তানিয়া গুড়ি মেরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আর একটু হলেই তারা গাড়ির নিচে লুকিয়ে যেতে পারবে।
পরিকল্পনা অনুসারে তখন সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশটা করা শুরু হল। মাস্তান দুজন তখন অবাক হয়ে দেখল গভীর জঙ্গলের ভেতর থেকে ফুটফুটে একটা মেয়ে বের হয়ে এসেছে। মেয়েটা যেন এ জগতের বাসিন্দা নয়, কোনো কিছুতে তার কোনো কৌতূহল নেই, খুব ধীরে পায়ে সে হেঁটে হেঁটে মাস্তান দুটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
মাস্তান দুজন প্রথম রুনুকে দেখে আতংকে প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেদেরকে সামলে নেয়। রুনু ধীরে পায়ে হেঁটে হেঁটে তাদের কাছে এগয়ে আসে। নিতু আর তানিয়া গাড়ির কাছে চলে এসেছে, মাস্তান দুটিকে ব্যস্ত রাখতে পারলে তারা গাড়ির নিচে ঢুকে যেতে পারবে। রুনু হেঁটে হেঁটে গাড়ির কাছাকাছি আসার সময়টুকুতে দুজন গাড়ির নিচে ঢুকে গেল।
রুনু হেঁটে হেঁটে মাস্তানদের কাছে এসে তাদের দিকে তাকিয়ে অশরীরি এক ধরনের গলায় বলল, আমার মা কে দেখেছ? মা? দেখ নাই, না? শুনলাম আমাকে ডাকল ব-কু-ল ব-কু-ল করে। কোথায় গেল আমার মা?
মানুষ গুলিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুনু অবাস্তব অশরীরি এক ধরনের ভঙ্গি করে জঙ্গলের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। ঠিক একই সময় রুনু জঙ্গলের যে অংশ থেকে বের হয়ে এসেছে ঠিক সেই অংশ থেকে ঝুনু বের হয়ে এল ঠিক আগের মতো।
কাচু নামের মাস্তানটা শুকনো গলায় বলল, ঐ টা কে, ওস্তাদ?
ওস্তাদ মুখ খিচিয়ে বলল? আমি কেমন করে বলব?
না মানে বলছিলাম কী-ইয়ে–বলে সে থেমে গেল, যে জিনিসটা বলতে চাইছে সেটা বলতে তার সাহস হল না।
ঝুনু ঠিক রুনুর মতো এগিয়ে আসছে এবং রুনুও তখনো পুরোপুরি চলে যায় নি। মাস্তান দুজন এক সাথে দুইজনকেই দেখতে পাচ্ছে। ঝুনু যখন হেঁটে হেঁটে মাস্তান দুইজনের কাছে এল তখন রুনু হেঁটে যাচ্ছে। মাস্তান দুজন বিস্ফোরিত চোখে একবার রুনুর দিকে তাকাল আরেকবার ঝুনুর দিকে তাকাল। ঝুনু অশরীরি গলায় বলল, তোমরা আমার মাকে দেখেছ? দেখ নাই? শোন নাই আমার মা ডাকছে ব-কু-ল? শোন নাই? কোথায় যে গেল মা, আর খুঁজে পাই না।
রুনু যতক্ষণ কথা বলছিল সেই সময়টাতে ঝুনু জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। ঝুনু খুব আস্তে আস্তে হাঁটবে আর সেই সময়টার মাঝে রুনু আবার বের হয়ে আসবে, মাস্তানগুলি দেখবে একই জায়গা থেকে আবার একই মানুষ বের হয়ে আসছে।
ঝুনু যখন খুব ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে তখন মাস্তান গুলি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন শিউরে উঠল। কাচু মাস্তান বলল, দে-দে-দেখেছেন?
হ্যাঁ।
দেখতে এক রকম। এ-এ-এ-কে বারে এক রকম।
ওস্তাদ শুকনো গলায় বলল, আসলে অন্ধকার তো এই জন্যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ম-ম-মনে এ-এ-হচ্ছে এক রকম।
না ওস্তাদ! হুবহু এক রকম। জামা কাপড় চেহারা গলায় স্বর সব কিছু একরকম।
কাচু মাস্তানের কথা শেষ হবার আগেই জঙ্গলের ভেতর থেকে রুনু বের হয়ে এল। মাস্তান দুজন একবার বুনুর দিকে তাকাল আবার রুনুর দিকে তাকাল। রুনু খুব অশরীরি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে আর ঝুনু অশরীরি ভঙ্গিতে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঝুনু মাস্তান দুইজনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, আমার মাকে দেখেছ তোমরা? খুঁজে পাচ্ছি না আমি। মনে হল শোনলাম ডাকছে ব-কু-ল কিন্তু গিয়ে দেখি নেই। কোথায় যে গেল আমার মা।
ঠিক তখন জঙ্গলের ভেতর থেকে কে যেন অশরীরী গলায় কেঁদে উঠল, কাতর, গলায় ডাকল, ব-কু-উ-উ-উ-ল।
রুনু সেদিকে তাকিয়ে বলল, ঐ যে ডাকছে আমার মা। যাই মায়ের কাছে।
রুনু কিন্তু খুব ব্যস্ততা দেখায় না, অশরীরী প্রাণীর জীবনে কোনো ব্যস্ততা নেই কোনো তাড়াহুড়া নেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঝুনুকে তার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সময় দিতে হবে সেটা হচ্ছে বড় কথা। এবং ঠিক পরিকল্পনা মতো আবার ঝুনু বের হয়ে এসে মাস্তান দুটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা দেখেছো আমার মাকে কোথায় গেছে আমার মা আমাকে ডাকছে ব-কু-ল- বকুল কিন্তু আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না।
মাস্তান দুটি বিস্ফোরিক চোখে দেখে জংগলের একই জায়গা থেকে একজনের পর একজন মেয়ে বের হয়ে আসছে সবাই দেখতে হুবহু একরকম!
কাচু মাস্তান এবারে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল, ভাঙ্গা গলায় বলল, দেখেছেন ওস্তাদ? চারবার এক মানুষ এসেছে? দেখেছেন?
ওস্তাদ চাপা গলায় বলল, আরো আসছে।
ওস্তাদ।
কী হল?
কী হবে এখন?
আয়তুল কুরসী পড় হারামজাদা।
জানি না।
তাহলে কলমা পড়।
একটা সমস্যা হয়ে গেছে।
কী সমস্যা?
না-পাক হয়ে গেছি ওস্তাদ। ভয়ের চোটে পেশাব হয়ে গেছে।