কাচু যাকে ওস্তাদ বলে ডাকছে, সেই মানুষটা উদাস উদাস গলায় বলল, বুঝলি কাচু, তুই বেশি তড়পাবি না। কাজ ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। যে কাজের যে স্টাইল। পলিটিক্যাল কাজ এক রকম টাকার কাজ অন্যরকম। টাকার কাজে কোনো মাথা গরম নাই, কোনো বাড়াবাড়ি নাই।
জে ওস্তাদ।
যখন দেখবি রিক্সাটা আসতেছে আমি কাঁটা রাইফেলটা নিয়ে আগাব। তুই পিছনে থাকবি। কথাবার্তা যা বলার আমি বলব। রিক্সাওয়ালাটা থাকবে তো তারেও নিউট্রালাইজ করতে হবে।
লাইট পোস্টটা যেন পিছনে থাকে। আলো আসবে পিছন থেকে চেহারা যেন ঠিক দেখতে না পারে। পুলিশের সাথে বন্দোবস্ত থাকলেও সব সময় সাবধান থাকতে হয়। বুঝলি?
জে ওস্তাদ, বুঝেছি।
আমি যখন বলব তখন রড দিয়ে মারবি। তার আগে না। মনে থাকবে?
থাকবে ওস্তাদ।
কাজ যেন ক্লীন হয়। এইটা টাকার কাজ। টাকার কাজ ক্লীন করলে কাস্টমার হাতে থাকে। পরের বারও বিজনেস দেয়। একটা বাড়ি দিয়ে হাঁটুটা গুড়া করে দিতে হবে। কোন্ হাঁটুটা করবি? ডান না বাম?
আমি তো বায়া, ডান হাঁটুতেই সুবিধা।
ঠিক আছে তাহলে ডান হাঁটু।
যাকে ওস্তাদ বলে ডাকা হচ্ছে সেই মানুষটা এবারে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ হয়ে গেল। কাচু নামের মানুষটা পুরো গাড়িটা একবার ঘুরে এসে শুকনো গলায় বলল, ওস্তাদ।
কী?
এইটা কী সেই জায়গা না?
কোন্ জায়গা?
সেই যে একটা স্কুলের ছেমড়ী সুইসাইড করল?
তাই নাকি?
জে ওস্তাদ। ছেমড়ীর নাম ছিল বকুল। গলায় দড়ি দিয়েছিল এইখানে।
অ।
কাচু কিছুক্ষণ পর বলল, জায়গাটা ভালো না।
কাচুর ওস্তাদ তখন চমকে উঠল, বলল, কী বলিস তুই?
জে ওস্তাদ, ঠিকই বলি। আপনি টের পাচ্ছেন না?
দুজনেই তখন ইতি উতি তাকাল এবং কাচুর ওস্তাদ ভয়ে ভয়ে বলল, ঠিকই বলেছিস। জায়গাটা জানি কেমন!
গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছয়জনও তখন চারিদিকে তাকাল, জায়গাটা অন্ধকার এবং নির্জন, গাছপালা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, কেমন যেন থমথমে ভাব। কেউ যদি মনে করে জায়গাটা ভৌতিক তাহলে খুব দোষ দেওয়া যায় না।
কাচু বলল, ওস্তাদ, আপনি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?
কাচুর ওস্তাদ শুকনো গলায় বলল, কী জিনিস?
এই জায়গাটাতে কোনো শব্দ নাই।
ওস্তাদ ভয়ে ভয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?
যে সব জায়গা খারাপ সেখানে কোনো পশুপক্ষী থাকে না ঝি ঝি পোকাও থাকে না। দেখেছেন—
কাচু আরো কী বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার ওস্তাদ ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল, চুপ কর হারামজাদা। কথা বলবি না।
গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিতু আর তার বন্ধুরা বুঝতে পারল এই মানুষ দুটি ভয় পাচ্ছে। নিতু গলা নামিয়ে বলল, এদের ভয় দেখালে কী রকম হয়?
ভয় দেখাবি? কথা বলতে গিয়ে রেবেকা নিজেই ভয় পেয়ে গেল।
হ্যাঁ। এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে, তার সাথে আর একটু চেষ্টা করলেই দেখাব কী ভয় পাবে।
আর একটু চেষ্টা কীভাবে করবি?
নিতু একটু চিন্তা করে বলল, মনে কর যদি একটা ঢিল ছুঁড়ি। কিংবা আরো ভালো হয়—
আরো ভালো হয়?
আরো ভালো হয় যদি জংগলের ভিতর থেকে একটা ভৌতিক শব্দ বের করা যায়। নিতু মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, মিতুল তুই পারবি না?
আমি?
হ্যাঁ। ভৌতিক একটা শব্দ করে লাইট বাল্বটা ঠাশ করে ভেঙ্গে ফেলবি। পারবি না?
মিতুল লাইট বাটার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু দূর হয়ে যায়, তবু মনে হয় পার।
দেখ কী মজা হয়!
তানিয়া ফিস ফিস করে বলল, দাঁড়া, আগেই শুরু করিস না।
পুরো জিনিসটা ঠিক করে প্ল্যান করে নেই আগে। একেবারে আগা গোড়া। কী কী করা হবে, সব কিছু।
রেবেকা মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ তানিয়া ঠিকই বলেছে। প্ল্যানটা ভালো করে করি।
নিতু একটু ইতস্তত করে বলল, দেরি না হয়ে যায় আবার হঠাৎ করে যদি এখন শান্তা আপা এসে যায়?
আয় তাহলে তাড়াতাড়ি প্ল্যান করে ফেলি।
গাছের আড়ালে বসে আবার নিখুঁত পরিকল্পনা করা হল। তাদের মূল উদ্দেশ্য গাড়ির উপর রাখা কাঁটা রাইফেল আর লোহার রডটা সরিয়ে নেওয়া। একবার কোনোভাবে সেই দুইটা সরিয়ে নিতে পারলে কোনো ভয় নেই সেগুলি দিয়েই তখন তাদের কাবু করা যাবে। নিতু আর তানিয়ার উপর ভার দেওয়া হল সেগুলি সরানোর। মাস্তান গুলিকে ব্যস্ত রাখার দায়িত্ব রুনু ঝুনু আর মিতুলের। কীভাবে ব্যস্ত রাখা হবে তার খুঁটিনাটি সবকিছু ঠিক করে নেয়া হল। হঠাৎ করে যদি সরাসরি মারামারি শুরু করে দিতে হয় তাহলে সেটা চালিয়ে নেওয়ার জন্যে কিছু প্রমাণ সাইজ ঢিল বিভিন্ন জায়গায় জমা করে রাখা হল। রেবেকা তার দায়িত্বে আছে, অন্ধকার থেকে মাস্তান দুটির দিকে ঢিল ছুঁড়ে দরকার হলে তাদেরকে কাবু করে দিতে হবে।
পরিকল্পনার খুঁটিনাটি কয়েকবার পরীক্ষা করে দেখে নেবার পর তারা উঠে দাঁড়ায়। নিজের নিজের কাজে রওনা দেবার আগে হঠাৎ রুনু ফিস ফিস করে বলল, রেবেকা, আমাদের বুকে ফুঁ দিয়ে দিবি না?
রেবেকা তখন আবার তিনবার কুলহু আল্লাহ পড়ে সবার বুকে ফুঁ দিয়ে দিল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে যায়। নিতু আর তানিয়া গুড়ি মেরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঠিক একই সময়ে রুনু ঝুন আর মিতুল রাস্তার পাশে দিয়ে বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গেল। রেবেকা তার জায়গায় বসে বড় বড় ঢিল সংগ্রহ করতে শুরু করে।
মিনিট খানেক পর পরিকল্পনার ঠিক প্রথম অংশ টুকু কাজে লাগানো হল। গাছ পালা টাকা থমথমে নির্জন জায়গাটায় হঠাৎ একটা অশরীরি কণ্ঠ শোনা যায়, কাতর গলায় সেটি আর্তনাদ করে কাকে যেন ডাকছে, কণ্ঠস্বরটি মানুষের নয়, মানুষের কণ্ঠস্বরে এরকম ব্যাকুল কান্নার মতো দুঃখ থাকতে পারে না। গাছের আড়ালে বসে মিতুল এভাবে ডাকছে জানার পরও নিতুর সারা শরীর কেমন যেন শিউরে উঠে।