তোর মা মারা গেছে? নিতুর মনে হল এই প্রথমবার কেঁদো বাঘের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, তুই নিশ্চয়ই এত যন্ত্রণা দিয়েছিস যে সেই যন্ত্রণায় তোর মা মরেছে? ঠিক কি না?
নিতু কিছু বলল না, অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করল। পাহাড়ের মতো মহিলা হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল, কুইক মার্চ।
নিতু বুঝল তাকে যেতে বলা হচ্ছে। সে রবোট মহিলার পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে শেষবার এই দানবীর দিকে তাকাল তারপর ফিসফিস করে মনে মনে বলল, আমি যদি আমার মায়ের বেটি হই তাহলে তোমাকে আমি একদিন টাইট করব।
পাহাড়ের মতো দানবী সেই কথা শুনতে পেল না, শুনতে পেলে সেই মুহূর্তে তার মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
০২. রুমমেট
রোট মহিলা প্রথমে নিতুকে নিয়ে গেল তার হোস্টেলে। সেখানে দুইশ বারো নম্বর রুমে হাসপাতালের বেডের মতো ছয়টা বিছানা, তার একটা খালি। সেখানে তার স্যুটকেসটা রেখে তাকে নিয়ে যাওয়া হল সুপারিনটেন্ডেন্টের অফিসে। সুপারিনটেন্ডেন্ট একজন খিটখিটে মহিলা, তার বেড়ানো গাল, কোটরের ভিতর ঢুকে থাকা চোখ, শিরা ওঠা শুকনা হাত। সুপারিনটেন্ডেন্ট নিতুর কাগজপত্র নিয়ে বড় বড় কয়েকটা খাতায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কী যেন লেখালেখি করল তারপর নিতুকে দাঁড় করিয়ে টানা আধঘণ্টা একটা লেকচার দিল। লেকচারের বিষয়বস্তু হল এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলা কত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই নিয়ম ভাঙ্গলে কী রকম কঠোর শাস্তি দেয়া হয় তার লোমহর্ষক বর্ণনা। অন্য যে কোনো সময় হলে এরকম একটা বক্তৃতা শুনে নিতুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতো কিন্তু কিছুক্ষণ আগে কেঁদো বাঘের মতো দেখতে সেই রাক্ষসী ম্যাডামের সাথে তার যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তাকে একেবারে পাথরের মতো করে দিয়েছে, তার ভিতরে এখন ভয়-ভীতি, রাগ-দুঃখ কোনো কিছুই নেই। কেমন জানি বোধশক্তি ছাড়া একটা পুতুলের মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হোস্টেলে সুপারিনটেন্ডেন্ট লেকচার শেষ করে জমিলার মা নামের রবোট মহিলার সাথে তাকে পাঠালো স্টোর রুমে। সেখানে ইঁদুরের মতো দেখতে আরেকজন মহিলা নিতুর শরীরের মাপ নিয়ে তাকে এক জোড়া স্কুলের পোশাক ধরিয়ে দিল। সাদা ব্লাউস আর ভুসভুসে কালো টিউনিক, দেখলেই নাড়ী উল্টে আসে। এই মন খারাপ করা পোশাক পরে তাকে এই স্কুলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে চিন্তা করেও নিতু খুব বেশি মুষড়ে পড়ল না—মুষড়ে পড়ার ক্ষমতাও তার শেষ হয়ে গেছে। স্কুলের পোশাক দুটি দেওয়ার পর ইঁদুরের মতো দেখতে মহিলাটি আবার অনেকক্ষণ নাকী সুরে কথা বলে গেল। কথার বিষয়বস্তু হচ্ছে কীভাবে এই পোশাকের যত্ন নিতে হবে এবং পোশাকের এতটুকু ছিঁড়ে গেলে তাকে কী কী কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। স্টোর রুম থেকে তাকে নেওয়া হল লাইব্রেরিতে, সেখানে তাকে তার ক্লাশের বই দিল থলথলে মোটা একজন মহিলা। মহিলাটি সব সময় বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, একটু নড়লেই বা একটা কথা বললেই দুইবার বড় বড় নিশ্বাস নিতে হয়। বই এবং খাতা নিতুর হাতে তুলে দিয়েও এই মহিলা একটা বড় লেকচার দিল–এখানেও লেকচারের বিষয়বস্তু এক, বই ছিঁড়ে ফেললে বা ময়লা করলে কী কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে তার একটা ভয়ংকর বর্ণনা।
রবোট মহিলা সেখান থেকে নিতুকে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে, ডাইনিং রুম থেকে একটা ছোট অন্ধকার জিমনাসিয়ামে সেখান থেকে নিজের রুমে। এতক্ষণে ক্লাশ ছুটি হয়ে গেছে, সবাই নিজের রুমে চলে এসেছে। নিতু তার নিজের ঘরে এসে দেখল প্রত্যেকটা বিছানায় একটা মেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় এই ঘরটিতে বুঝি কোনো বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেই গ্যাসে সবাই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। নিতু কী করবে বুঝতে পারল না, হেঁটে হেঁটে কাছাকাছি বিছানায় শুয়ে থাকা একটা মেয়ের কাছে যেতেই মেয়েটা চোখ খুলে ফিসফিস করে বলল, তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়।
নিতু অবাক হয়ে বলল, কেন?
কথা বল না। যদি জানে বাচতে চাও শুয়ে পড়ো।
নিতু কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু এটা নিয়ে আর তর্ক করার সাহস পেল। নিজের বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রায় সাথে সাথে শুনতে পেল দুম দুম করে শব্দ হচ্ছে। মনে হয় ভয়ংকর কোনো একটা প্রাণী হেঁটে হেঁটে আসছে। দড়াম করে ঘরের দরজা খুলে গেল, নিতু বুঝতে পারল তাদের ঘরে সেই প্রাণীটা এসে ঢুকেছে, সে তার চোখ বন্ধ করে ফেলল, চোখ বন্ধ করেই টের পেল একজন ঘরের মাঝে হেঁটে হেঁটে তাদের পরীক্ষা করছে। ঠিক তার বিছানার কাছে এসে পায়ের শব্দ থেমে যায়, প্রাণীটা তাকে পরীক্ষা করছে। নিতু একবার ভাবল চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কিন্তু সাহস পেল না, তার মনে হতে লাগল এক্ষুনি বুঝি তার চুলের ঝুঁটি ধরে কেউ টেনে তুলে ফেলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা ঘটল না। শুনতে পেল দুম দুম করে পায়ের শব্দ দূরে সরে যাচ্ছে, দরজার কাছে গিয়ে শব্দটী এক মুহূর্তের জন্যে থামল তারপর দরজা খুলে দড়াম করে আবার বন্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথে নিতু চোখ খুলে তাকায়, দেখে আশপাশে সব বিছানায় মেয়েগুলি চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে।
নিতু ভয়ে ভয়ে বিছানায় উঠে বসে, সাথে সাথে অন্যেরাও সাবধানে উঠে বসে। একজন পা টিপে টিপে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। তারপর নিতুর কাছে এগিয়ে এল। নিতু শুকনো গলায় বলল, কী হচ্ছে এখানে?