শান্তা আপার উপর কী রকম আক্রমণ করা হবে ঠিক করার পর তার জন্যে মাস্তানদের কত টাকা দিতে হবে সেটা নিয়ে দরদাম করা শুরু হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল একেবারে মাছের বাজারে মানুষ যেভাবে দরদাম করে ঠিক সেই ভাবে দরদাম করা হল খোরাসানী মাঙামকে মনে হল এই লাইনে খুব অভিজ্ঞ, খুন করা জন্যে কত রেট, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে কত, রগ কেটে দেওয়ার জন্যে কত বা গাড়ি ভাংচুর করার জন্যে কত রেট সব তার একেবারে মুখস্ত। শুধু তাই না বছরের কোন সময় এবং কোন্ দলের কোন্ সরকার থাকলে সেই রেট কীভাবে বাড়ে কমে সেটাও খোরাসানী ম্যাডাম জানে। তাই মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে এক হাজার নগদ, দুই হাজার কাজ শেষ হবার পর) রাত নয়টার দিকে স্কুলের রাস্তার নির্জন অংশে শান্তা ম্যাডামকে আক্রমণ করে পায়ের হাটু ভেঙ্গে দেওয়ার একটা কন্ট্রাক্ট করে ফেলা হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিজের কানে না শুনলে এটা বিশ্বাস কত কী না সন্দেহ।
খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে ফিসফিস করেও কথা বলা যায় না তাই নিতু রেবেকা আর তনিয়ার অপেক্ষা করতে হল। খোরাসানী ম্যাডাম যখন টেলিফোনে হোস্টেলের চাউল সাপ্লয়ারের সাথে প্রতি কে জি চাউলের জন্যে তাকে কত টাকা ভাগ না দিলে সে অন্য সাপ্লায়ারের কাছে চলে যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে থাকল তখন তারা গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলতে থাকে। নিতু বলল, শান্তা আপাকে বাঁচানোর জন্যে এক্ষুনি আমাদের যেতে হবে।
কীভাবে যাবি?
যখন টেলিফোনে কথা বলছে তখন বের হয়ে যাই।
কিন্তু–
কোনো কিন্তু নাই। তাড়াতাড়ি চল—
কিন্তু বের হতে হতে টেলিফোনে আলাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা আবার খাটের নিচে আটকা পড়ে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম এবারে খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, তার সমস্ত শরীরের ওজনে পুরো খাটটা মটমট করতে থাকে। নাড়া চাড়া করার সময় খোরাসানী ম্যাডাম মাঝে মাঝেই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠেছিল এবং সাথে সাথে তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল, একজন মানুষ—বিশেষ করে মেয়ে মানুষ যে এরকম ভাষায় গালাগাল করতে পারে নিজের কানে না শুনলে ওরা বিশ্বাস করতে পারত না। খোরাসানী ম্যাডাম যদি জানত যারা তার এই দুরবস্থা করেছে তারা এই মুহূর্তে তার খাটের নিচে শুয়ে আছে তাহলে সে কী করত কে জানে!
এভাবে বেশ সময় কেটে গেল। নিতু রেবেকা আর তানিয়া যখন খাটের নিচে আটকা পড়ে বের হতে না পেরে একেবারে অস্থির হয়ে গিয়েছে ঠিক তখন তারা পৃথিবীর মধুরতম শব্দটি শুনতে পেল, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে খোরাসানী ম্যাডাম ঘুমিয়ে পড়েছে, বাঁশির মতো তার নাক ডাকতে শুরু করেছে। মানুষের নাক ডাকার শব্দ যে এত ভালো লাগতে পারে সেটি তারা এর আগে কখনো কল্পনা করে নি।
তিনজন এবারে খুব সাবধানে খাটের নিচে থেকে বের হয়ে এল—যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া সম্ভব ছিল তাদের তার থেকে একটু বেশি সময় লাগল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। খাটের নিচে থেকে বের হওয়ার সময় তারা আবিষ্কার করল সেখানে যেসব জিনিস গাদাগাদি করে রাখা আছে তার মাঝে একটি হচ্ছে একটা বড় তেলের টিন। তারা সেটা খুলে পুরো তেলটুকু মেঝেতে ছড়িয়ে দিল। খোরাসানী ম্যাডাম যদি হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠে তাদের পিছু নিতে শুরু করে তাহলে তেলে পা পিছলে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে তাদেরকে পালিয়ে যাবার জন্যে খানিকটা বাড়তি সময় দেবে? যদি পিছু নাও নেয় ঘুম থেকে উঠেও সে যদি খামোখা ধড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে হাত পা কিংবা মাথা ভেঙ্গে ফেলে তাদের কারো মনে এতটুকু দুঃখ হবে না।
১২. এডভেঞ্চার
নিতু, রেবেকা আর তানিয়া কোনো কিছু করার আগে খুব ভালো ভাবে পরিকল্পনা করার সুফলটা টের পেল খুব তাড়াতাড়ি। দেওয়াল টপকে স্কুল থেকে বের হয়ে স্কুলের বাইরে রাস্তা ধরে হেঁটে একেবারে শেষ মাথায় বাস স্টেশনে চলে গিয়ে দেখতে পায়। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে মিতুল, রুনু-ঝুনু অপেক্ষা করছে, তবে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় আর কী করবে সেই অনিশ্চয়তায় একেবারে আধখানা হয়ে গেছে।
মিতুল আর রুনু-ঝুনু অন্য তিনজনকে দেখে যা খুশি হল সেটি আর বলার মতো নয়। একজন আরেকজনকে ধরে খানিকক্ষণ জাপটা জাপটি করে নেয় তারপর দ্রুত কাজের কথায় চলে আসে।
আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই।
শান্তা আপা কোন রাস্তা দিয়ে আসবে আমরা জানি, সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকবি। যখন দেখব শান্তা আপা রিক্সা করে আসছেন, দৌড়ে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে সবকিছু বলব, তারপরে আমাদের আর কিছু চিন্তা করতে হবে না।
কিন্তু পুলিশ কিংবা কোনো বড় মানুষকে বললে হতো না? মিতুল পুরো ব্যাপার নিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে, যদি মনে কর কোনোভাবে আমরা ঠিক করে খেয়াল করতে না পারি আর শান্তা আপা চলে যান? তাহলে মিতুল ব্যাপারটা চিন্তা করে একেবারে শিউরে উঠে।
তানিয়া মাথা নাড়ল, বলল, মিতুল ঠিকই বলেছে। যদি শান্তা আপাকে থামাতে না পারি তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে।
নিতু বলল, তার মানে যেভাবেই হোক আমাদেরকে শান্তা আপাকে থামাতেই হবে। পুলিশের কাছে যেতে পারলে ভালোই হতো—কিন্তু দেরি হয়ে যাবে না?
তানিয়া বলল, আমরা আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই। এক ভাগ যাই পুলিশের কাছে আরেক ভাগ যাই স্কুলের রাস্তায়, শান্তা আপাকে থামাতে।