খোরাসানী ম্যাডাম বিছানায় একটু আরাম করে বসে একটা হুংকার দিয়ে বলল, তারার মা–আমার হুক্কা টা—
খাটের নিচে বসে তিন জন চমকে উঠে, হুক্কা? হুক্কা মানে নিশ্চয়ই হুকো, কোনো মহিলা কী কখনো ইকো খেতে পারে? তাদের সন্দেহ একটু পরেই দূর হয়ে গেল, সত্যি সত্যি তারার মা নামে একজন বুড়ি একটা হুকোর ওপর কলকেতে জ্বলন্ত অংগারে ফুঁ দিতে দিতে নিয়ে আসে। সেটা বিছানার পাশে রেখে বলল, খাবার দিব?
দে।
আমার একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার ছিল— কথা শেষ হওয়ার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম তারার মাকে সুশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ শুরু করে, সেই গালি গালাজের ভাষা এত খারাপ যে খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে নিতু রেবেকা আর তানিয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। খোরাসানী ম্যাডাম এত খারাপ গালগাল দিতে পারে অথচ সে তুলনায় তাদেরকে যে গালি গালাজ করে সেটা রীতিমতো ভদ্র ভাষা, ব্যাপারটা চিন্তা করে এই প্রথমবার খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে তাদের ভিতর একটু কৃতজ্ঞতার জন্ম নেয়। গালাগালি শেষ করে খোরাসানী ম্যাডাম মনে হল শুয়ে থেকেই তারার মাকে একটা লাথি মারার চেষ্টা করল। তারার মা নিশ্চয়ই এরকম আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত, এতকিছু ঘটে যাবার পরও শান্ত গলায় বলল, টেবিলে খাবার ঢেকে রাখব আফা, আপনি খেয়ে নিবেন কথা শেষ হবার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম, যা হারামজাদি, যা ভাগ, তোর চাকরি শেষ- বলে তাকে দূর করে দিল।
তারার মা ঘর ছেড়ে যাবার সাথে সাথে খোরাসানী ম্যাডাম গুড় গুড়ক করে হুকো টানতে থাকে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে হাটে নিচে শুয়ে থাকে, খোরাসানী ম্যাডাম কী মানুষ না অন্য গ্রহের একটা ভয়ংকর প্রাণী সেটা নিয়ে তাদের সন্দেহ হতে থাকে। খানিকক্ষণ ঘরে হুকোর গুড়ক গুড়ুক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একসময় হঠাৎ মনে হল খোয়াসানী ম্যাডাম কিছু একটা টেনে নিল, জিনিসটা কী একটু পরেই বোঝা গেল, একটি টেলিফোন। কোনো এক জায়গায় ডায়াল করে কথা বলতে শুরু করে খোরাসানী ম্যাডাম।
কালু, খবর কী, বল?
টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে কী খবর দেওয়া হল ওরা শুনতে পেল না কিন্তু খবরটা যে গুরুতর সেটা খোরাসানী ম্যাডামের কথা শুনে বোঝা গেল, ম্যাডাম প্রায় চিৎকার করে বলল, কী বললি? আবাগীর বেটি গেছে নয়নপুর? জোহরা কামাল নিয়ে খোঁজ নিতে?
খাটের নিচে নিতু রেবেকা আর তানিয়া একসাথে চমকে উঠল। তাদের কাছে বেগম জোহরা কামালের দলিল পত্র, তিনি থাকতেন নয়নপুরে! আবাগীর বেটি বলাতে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে তাদের শান্তা আপাকে! তার মানে শান্তা আপা নিজে নিজেই বেগম জোহরা কামাল সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছেন?
কী বললি? দলিলগুলি খোঁজ করছে? সর্বনাশ! যদি কোনোভাবে পেয়ে যায় আমাদের কী অবস্থা হবে টের পাচ্ছিস? খোরাসানী ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, স্কুলের জমি যা দখল নিয়েছি সব যাবে! মনে হয় জেল টেলও হয়ে যাবে।
গুড়ুক গুড়ুক করে হুকো খাওয়ার শব্দ হতে লাগল এবং খোরাসানী ম্যাডাম টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে যে কথা বলা হচ্ছে সেটা শুনতে লাগল, যার সাথে কথা বলছে সে নিশ্চয়ই খুব ঘনিষ্ঠ, মহিলা হয়ে সে যে হুকো টানছে সেটা নিয়ে তার কোনো লজ্জা নাই।
খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানা বন্ধ করে বলল, মনে হয় তোর কথাই ঠিক। জোহরা কামালের বাক্স খুঁজে পাওয়া গেলে এতদিনে পাওয়া যেতো! এই স্কুলের মাঝেই তো থাকবে, আমি ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুজেছি। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) আর এই বাক্সে যদি খুঁজে না পায় তাহলে আমাদের কিছু করতে পারবে না। জাল দলিল যেটা তৈরি হয়েছে সেইটা আসল দলিলের বাপ। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) তবে আবাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী মহা ঝামেলা তৈরি করেছে। সেইদিনের ছেমড়ী কিন্তু শালীর বুদ্ধি কী সাংঘাতিক! অফিসের দুইটা কাগজ দেখেই সন্দেহ করে ফেলল। (গুড়ুক গুড়ুক)। বুঝলি কালু, আবাগীর বেটির কোনো ভয় ডর নাই, পুরা স্কুলটাকে ওলট পালট করে ফেলল।
খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানতে টতে আবার অন্য পাশে কী বলছে শুনতে থাকে, খানিকক্ষণ শুনে বলল, তাহলে তুই খবর পেয়েছিস আবাগীর বেটি ফিরে আসছে? আমি জানি কোথায় আসছে। (গুড়ুক গুড়ুক) আবাগীর বেটি ফিরে আসছে স্কুলে। তার পিয়ারের মেয়েদের দেখতে—তাদেরকে না বলে চলে গেছে তো, সেইজন্য মন টিকছে না। এসে নিশ্চয়ই তাদের বোঝ দিবে, সাহস দিবে। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) দাঁড়া আমি বোঝাচ্ছি ঠেলা। কয়টার দিকে পৌঁছাবে বল দেখি?
টেলিফোনের অন্য পাশে বলা হল কয়টার সময় শান্তা আপা স্কুলে পৌঁছাবেন কিন্তু নিতু রেবেকা আর তানিয়া সময়টা শুনতে পেল না, তারা শুনল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, ঠিক আছে তাহলে আমি বাকি ব্যবস্থা করি। ওই আবাগীর বেটিরে আমি সিধা করে ছেড়ে দিব। (গুড়ুক গুড়ক) কালু, তুই জানিস শান্তা ছেমড়ি কী অবস্থা করেছে? মেয়েদের এমন লাই দিয়েছে যে ছয় ছয়টা মেয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গেছে! স্কুলের ভিতর ইঞ্চি ইঞ্চি করে খোঁজা হয়েছে কোথাও নাই। সেই রিপোর্ট ও দিতে হবে (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) কিছু আর ভালো লাগে না। বদমাইস গুলিরে ধরতে গিয়ে বেকায়দা পড়ে মাজাটায় যা ব্যথা পেয়েছি, ওহ! রেখে দেই কালু, অনেক কাজ বাকি।
খোরাসনী ম্যাডামের অনেক কাজ কী সেটা বোঝা গেল একটু পরে, ফোন করে কথা বলতে শুরু করল শহরের বড় কোন্ মাস্তানের সাথে। স্কুলের রাস্তার ঠিক কোন্ নির্জন জায়গায় রাত নয়টার দিকে রিক্সা করে শান্তা আপা আসবেন এবং সেখানে কী ভাবে তাকে আক্রমণ করে আচ্ছা মতন শিক্ষা দিতে হবে সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে থাকল। আচ্ছা মতন শিক্ষা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটাও ব্যাখ্যা করা হল, জানে মারতে হবে না, হাত পা কিছু একটা ভেঙ্গে দিতে হবে। কোনো জয়েন্ট ভাঙ্গলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেওয়া যায়, সারতে খুব বেশি সময় নেয় এটা নিয়েও দীর্ঘ সময় আলোচনা করা হল। যে কাজটা ঠিক করে করতে হবে সেটা হচ্ছে ভয় দেখানো—এমন ভয় দেখাতে হবে যেন শান্তা চৌধুরী আর জীবনে এই এলাকায় না আসেন। যে মাস্তানের সাথে কথা হচ্ছে সে কীভাবে ভয় দেখাবে টেলিফোনে খোরাসানী ম্যাডামকে শোনাল এবং পদ্ধতিটা খোরাসানী ম্যাডামের খুব পছন্দ হল বলে মনে হল কারণ খোরাসানী ম্যাডাম দুলে দুলে হাসতে শুরু করল! বুতুরুন্নেসা স্কুলের কোনো মেয়ে কোনো দিন খোরাসানী ম্যাডামকে হাসতে দেখে নি, এখন হঠাৎ করে তার হাসি শুনে নিতু, রেবেকা আর তানিয়া কেমন জানি শিউরে উঠে, তাদের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকে, একজন মানুষের হাসি এরকম ভয়ংকর হতে পারে তারা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করতো না—হাসার সময় তার মুখটাও না জানি কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে!