কিন্তু —।
কোনো কিন্তু নাই, ঘর থেকে বের হ। তাড়াতাড়ি।
তাদের ব্যাগ আগে থেকে প্রস্তুত করা ছিল, হাতে নিয়ে তিনজন চোখের পলকে ঘর থেকে বের হয়ে এল। হৈ হল্লা এবং চেঁচামেচি শুনে সবাই জানালার কাছে চলে গেছে বলে তিনজন সবার চোখ এড়িয়ে সহজেই হোস্টেল থেকে বের হয়ে এল। হোস্টেল থেকে দূরে সরে গিয়ে স্কুল ঘরের সিঁড়ির পিছনে তিনজনই লুকিয়ে গেল।
নিতু যে রকম সন্দেহ করেছিল ঠিক তাই ঘটল, কয়েক মিনিটের মাঝে খোরাসানী ম্যাডাম তার দল বল নিয়ে হোস্টেলে তাদের ঘরে হাজির হল। তারা এতদূর থেকে শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলছে, খুঁজে বের কর সবগুলিকে। সব বদমাসি পাজী হতছাড়া শয়তানের বাচ্চাদের। এক্ষুনি খুঁজে বের কর। না হলে সবগুলিকে আমি কাল সকালের মাঝে তাড়িয়ে দেব। আস্ত রাখব না একটাকেও।
কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল খোরাসানী ম্যাডামের চেলারা তাদের খোজাখুজি শুরু করে দিয়েছে। ওরা শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম চিল্কার করে বলছে, টর্চ লাইট নিয়ে বাইরে যেতে, সবাই নিশ্চয়ই পালাতে পারে নাই, একটা দুইটা নিশ্চয়ই সীমানার ভিতরেই আছে, যেভাবে সম্ভব খুঁজে বের করতেই হবে।
রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেল।
হ্যাঁ নিতু ফিস ফিস করে বলল, টর্চ লাইট নিয়ে খুঁজতে শুরু করলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে।
আমাদেরকে পেয়ে গেলে কী হবে চিন্তা করেছিস?
তানিয়া বলল, আমি চিন্তা করতে চাই না।
আমিও চিন্তা করতে চাই না।
কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।
তা ঠিক। নিতু চিন্তিত মুখে বাইরে ইতি উতি তাকাতে থাকে, ভালো করে লুকানোর একটা জায়গা খুঁজতে থাকে কিন্তু সে রকম কোনো জায়গাই খুঁজে পায় না। এক পাশে হোস্টেল, অন্য পাশে দূরে খোরাসানী ম্যাডামের বাসা এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল, বলল, পেয়েছি।
কী পেয়েছিস?
লুকানোর জায়গা।
কোথায়।
খোরাসানী ম্যাডামের বাসা। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আয়।
রেবেকা আর তানিয়া মুখ হা করে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারা এখনো বুঝতে পারছে না নিতু ফাজলেমি করছে কী না। কিন্তু এখন আর যাই করা যাক না কেন ফাজলেমি করার সময় নয়। তানিয়া চাপা গলায় বলল, কী বলছিস তুই?
নিতু অধৈর্য হয়ে বলল, বুঝতে পারছিস না? আমাদেরকে এই স্কুলের সীমানার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় খুঁজবে শুধু একটি জায়গা ছাড়া। সেটা হচ্ছে খোরাসানী মডামের বাসা। আয় সেই বাসার ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকি, যখন খোজা বন্ধ করবে তখন বের হয়ে যাবো। আয়, দেরি করিস না।
তানিয়া মাখা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছিস।
রেবেকা এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিল না কিন্তু তিনজনের মাঝে দুজন রাজি হয়ে যাওয়ার তার আর কিছু করার ছিল না।
কিছুক্ষণের মাঝে তিনজন খোরাসানী ম্যাডামের বাসায় হাজির হল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরে অনেক জায়গা। খোরাসানী ম্যাডাম খুব ভাল করে জানে কেউ কখনো তার বাসায় নিজে থেকে ঢুকাবে না তাই দরজা হাট করে খোলা। নিতু রেবেকা আর তানিয়া চুপি চুপি ভিতরে ঢুকে যায়। লুকানোর জন্যে সবচেয়ে ভালো জায়গা পেলো একটা বড় খাটের তলা, সামনে নানারকম বস্তা, প্যাকেট হাড়ি কুড়ি রাখা, পিছনে তিন জনের লুকিয়ে থাকার প্রচুর জায়গা। খোঁজাখুঁজির উত্তেজনাটা পার হয়ে গেলে তারা বের হয়ে আসবে। আর যদি বের হতে নাও পারে রুনু ঝুনু আর মিতুল শান্তা আপাকে খুঁজে বের করে তাদেরকে উদ্ধার করার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে।
তিনজন গুটি শুটি মেরে খাটের নিচে শুয়ে রইল এবং বাইরে হৈ চৈ চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল খোরাসানী ম্যাডাম আর তার চেলা চামুণ্ডা মিলে তাদেরকে খুঁজছে। খানিকক্ষণ পর রেবেকাকেও স্বীকার করতে হল এখানে এসে না লুকালে আজকে তাদের আর জানে বেঁচে থাকার কোন উপায় ছিল না!
খোরাসানী ম্যাডামের বিশাল খাটের নিচে প্রচুর জায়গা এবং মনে হচ্ছে বেশ নিরাপদেই সেখানে শুয়ে থাকা যাচ্ছে কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই তারা খানিকটা অধৈর্য হয়ে পড়ল। বিশেষ করে রেবেকার অবস্থা হল খুব খারাপ, সে মাকড়শাকে খুব ভয় পায় আর তার মনে হতে থাকে বড় বড় গোবদা মাকড়শা খাটের নিচে ঘোরা ফেরা করছে আর যে কোনো মুহূর্তে তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। ভয় পেলে যদি গলা ফাটিয়ে চিল্কার করা যায় তাহলে একটু আরাম হয়, কিন্তু তারা এমন জায়গায় লুকিয়ে আছে যে তারা যত ভয়ই পাক না কেন এতটুকু শব্দ করতে পারবে না, সেটাই হয়েছে মুশকিল। তা ছাড়া কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে সেটাও আন্দাজ করতে পারছে না। সন্ধে হয়ে গেছে, একটু পরে রাত হয়ে যাবে। রাত্রি বেলা তাদের মতো ছোট ছোট মেয়েরা বাইরে ঘুরোঘুরি করবে কেমন করে?
তাদের সমস্যার সমাধান অবিশ্যি নিজের থেকেই হয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই তারা শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম ফিরে আসছে। খোরাসানী ম্যাডাম হাঁটলে গুম গুম করে একটা শব্দ হয়, কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে এখন শব্দটা হচ্ছে গুম ক্যাঁৎ গুম কঁাৎ….। কারণটা তারা একটু পইে টের পেল। রুনু বুনুকে তাড়া করে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে এবং মিতুলের ঝুলিয়ে রাখা চাদর বেয়ে উঠতে গিয়ে আছাড় খেয়ে খোরাসানী ম্যাডাম একটা পায়ে ভালো রকম ব্যথা পেয়েছে, সেই পাটা ফেলতে হচ্ছে খুব সাবধানে। তার বিশাল শরীরের ওজন সেই পায়ের ওপর ভর করতে গিয়ে কোথা থেকে জানি কাত করে শব্দ হচ্ছে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া খাটের তলায় বসে থেকে দেখতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম খোঁড়াতে খোঁড়াতে এই ঘরে এসে হাজির হয়েছে এবং যন্ত্রণার একরকম শব্দ করে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। সাথে সাথে পুরো বিছানাটি নিয়ে নেমে এল, নিতু রেবেকা আর তানিয়ার মনে হল বুঝি খাটটা ভেঙ্গে তাদের খাটের নিচে পিষে ফেলবে তারা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল কিন্তু খাটটা ভেঙ্গে পড়ল না।