রেবেকার কথা শুনে মিতুল মনে হয় একটু সাহস পেলো। সে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি গেলাম। দোয়া করিস। একটু থেমে যোগ করল, বেঁচে থাকলে দেখা হবে।
কেউ কোনো কথা বলল না এবং মিতুল দরজা খুলে বের হয়ে গেল। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যায় সে হোস্টেলের পিছনে পৌঁছে গেছে। অন্ধকারে ঝােপঝাড় ভেঙ্গে মিতুল ছুটে যেতে থাকে এবং দেখতে দেখতে সে হোস্টেলের পিছনে দেওয়ালের কাছে পৌছে গেল। মিতুল দেয়ালের কয়েকটা জায়গা পরীক্ষা করে একটা জায়গা বেছে নিয়েছে, অন্ধকারে অনেকদূর থেকে ঠিক স্পষ্ট দেখা গেল না, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত যে দেওয়াল বেয়ে ওঠে পড়তে পারল, সেটা বোঝা গেল। দেওয়ালের ওপর বসে গুড়ি মেরে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিতুল একটা জায়গা পছন্দ করে টুপ করে নেমে পড়ল এবং সাথে সাথে ঘরের ভিতরে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিতু বলল, দেখলি কত সহজ?
রেবেকা বলল, এবারে রুনু।
নিতু মাথা নাড়ল, বলল, তোর জন্যে কাজটা আরো সহজ। মিতুল চাদরটা ধরে রেখেছে তুই শুধু বেয়ে উঠে যাবি।
রেবেকা বলল, যা রওনা দে। দেরি করিস না।
ঝুনু বলল, আমি আর রুনু এক সাথে যাই?
রুনু সায় দিল, যা যাই? তাহলে এক সাথে দুইজন চলে যাব।
দুই বোন সবসময় এক সাথে থাকে তাই এবারেও কেউ আপত্তি করল না। নিতু বলল, যা, রওনা দে।
রুনু আর ঝুনু দু জনের ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সাবধানে দরজা খুলে মাথা বের করে এদিকে সেদিক তাকিয়ে বের হতে গিয়ে আবার ফিরে এসে রেবেকাকে বলল, আমাদের ফুঁ দিবি না?
রেবেকা বলল, আয়, কাছে আয়।
দুজনে কাছে এগিয়ে এল তখন রেবেকা আবার চোখ বন্ধ করে কুলহু আল্লাহ পড়ে দুজনের বুকে ফুঁ দিয়ে দিল। রুনু ঝুনু আবার ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয় তারপর সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে যায়। ঘরের ভেতরে বসে পিছনের জানালা দিয়ে বাকি তিনজন উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে। মিতুল যে রকম প্রায় সাথে সাথেই হোস্টেলের পিছনে চলে এসেছিল রুনু ঝুনুর বেলায় সেটা সত্যি হল না অনেকক্ষণ সময় পার হয়ে গেল কিন্তু তবু তার পিছনে এল না। রেবেকা ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! কোনো বিপদ হল না তো?
কী বিপদ?
ধরা পড়ে গেল না তো?
ধরা পড়ে গেলে চেচামেচি হৈ চৈ হতো না। কোনো রকম হৈ চৈ তো হচ্ছে না।
নিতুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে বাইরে বিশাল হল্লা শোনা গেল। নিতু রেবেকা আর তানিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখল তাতে তাদের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে তার মাঝেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুনু আর ঝুনু প্রাণ নিয়ে দেওয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে আর তাদের পিছু পিছু চিৎকার করতে করতে ছুটছে খোরাসানী ম্যাডাম। রুনু আর ঝুনু হালকা পাতলা কাজেই তারা ছুটছে একেবারে তীরের মতো, পিছু পিছু খোরাসানী ম্যাডামকে মনে হচ্ছে একটা চলন্ত ট্রাক, গাছ পালা ঝােপ ঝাড় ভেঙ্গে একেবারে কামানের গোলার মতো ছুটে যাচ্ছে। চিৎকার শুনে হোস্টেলে সবাই পিছনের জানালায় চলে এসেছে সবাই হতবাক হয়ে দেখছে রুনু ঝুনু পাই পাই করে ছুটছে আর তাদেরকে ধরার জন্যে ছুটছে খোরাসানী ম্যাডাম।
হোস্টেলের পিছনে অনেকটা জায়গা, খোরাসানী ম্যাডাম তার বিশাল শরীর নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠেছে। তা ছাড়া দেখতে পাচ্ছে সামনে দেওয়াল, সেখানে পৌঁছালে তো আর যাবার জায়গা নেই তখন তো এমনিতেই ধরা পড়ে যাবে ভেবে খোরাসানী ম্যাডাম তার দৌড়ে একটু রাস টেনেছে, সেই সুর্যোগ দুইবোন দেওয়ালের কাছে পৌছে গেল। মিতুল চাদর ঝুলিয়ে রেখেছে দুই বোন সেই চাদর ধরে একেবারে বানরের বাচ্চার মতো উপরে উঠতে শুরু করল। খোরাসানী ম্যাড়ম যখন হঠাৎ করে বুঝতে পারল দুইজন দেওয়াল টপকে পালিয়ে যাচ্ছে তখন আঁ আঁ আঁ করে আবার চিৎকার করতে করতে একেবারে রেলগাড়ির মতো ছুটে আসতে লাগল, এত বড় একটা মানুষ যে এত জোরে ছুটতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। আর একটু হলে খোরাসানী ম্যাডাম দুইজনের একজনকে ধরে ফেলত, কিন্তু তারা ঠিক সময় মতো তার বিশাল থাবা ফসকে কোনো মতে পার হয়ে ঝুপ ঝুপ করে দেওয়ালের অন্যপাশে লাফিয়ে পড়ল। খোরাসানী ম্যাডাম তার বিশাল ছুটন্ত দেহকে সামলাতে না পেরে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আরেকটু হলে পুরো দেওয়ালটাকেই ধ্বসিয়ে দিত, কিন্তু তা না করে বিশাল শব্দে সে নিজেই নিচে আছড়ে পড়ল। গা গা গাঁ শব্দ করে সেই অবস্থাতে লাফিয়ে উঠে সে চাদরটা ধরে ঝুলে পড়ল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, এই বিশাল দেহটিকে অন্য পাশ থেকে মিতুল একা নিশ্চয়ই ধরে রাখতে পারবে না–তাই তারা যেটা ভাবছিল ঠিক সেটাই ঘটল হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ধপাস করে নিচে আচড়ে পড়ল এবং এই প্রথম বার সবাই তার একটা কাতর আর্ত চিৎকার শুনতে পেল। পড়ে গিয়ে নিশ্চয়ই বেকায়দা ভাবে ব্যথা পেয়েছে কারণ দেখা গেল খুব সহজে আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। জমিলার মা এবং আরো দুয়েকজন তার দিকে ছুটে যাচ্ছে টেনে তোলার জন্যে।
নিতু এবারে রেবেকা আর তানিয়ার দিকে তাকাল, তারপর উত্তেজিত গলায় বলল, আমরা ধরা পড়ে গেছি। এখনই পালাতে হবে।
রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, কোথায় পালাব?
জানি না, এক্ষুনি ঘর থেকে বের হ। ম্যাডাম এক্ষুনি আমাদের খোঁজ করতে আসবে।