নিতু আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ল, এই স্কুলের সকল মেয়েদের পড়াশোনার সাথে সাথে শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে উৎসাহী করতে হবে। যারা গান গাইতে পারে তাদেরকে আলাদাভাবে গান শেখাতে হবে এবং জ্যোৎস্না রাতে স্কুল প্রাঙ্গণে সবাইকে নিয়ে মধুর গানের আসরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে? নিতু মুখ তুলে বলল, দেখলি?
আর কী লেখা আছে? পড় দেখি—
নিতু আবার পড়তে শুরু করছিল ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল, রুনু খোঁজ নিতে এসেছে। নিতু ফাইলটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল, বলল, চল যাই।
রুনু তালা খুলে দিতেই সবাই বের হয়ে এল, দরজায় আবার তালা লাগিয়ে সবাই সাবধানে নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার সবাই ফাইলটা নিয়ে বসে। সবাই পুরো ফাইলটা খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। বেগম জোহরা কামাল নামে একজন মহিলা তার বিশাল সম্পত্তির পুরোটা মেয়েদের একটা চমৎকার স্কুল তৈরি করার জন্যে দান করে দিয়ে গিয়েছেন। স্কুলটি কীভাবে চালাতে হবে তার একেবারে খুটি নাষ্টি এখানে লেখা আছে সেটি মানা না হলে কী করা হবে তাও বলে দেয়া আছে। অথচ সেই চমৎকার স্কুলটি বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় নাম নিয়ে একটা ভয়ংকর কয়েদখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোটা পড়ে নিতু ফাইলটা বন্ধ করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পারছিস?
কোনটার কথা বলছিস?
আমাদের এখন কি করতে হবে?
কী?
শান্তা আপাকে খুঁজে বের করে তার কাছে এই ফাইলটা দিতে হবে।
মিতুল হাতে কিল দিয়ে বলল, ইয়েস!
অন্য সবাই তাদের হাতে কিল দিয়ে বলল, ইয়েস! ইয়েস!! ইয়েস!!!
১১. পলায়ন
বসে বসে সবাই খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করল। অন্ধকার হওয়া মাত্র তারা ছয়জন ঘর থেকে বের হবে। এক সাথে বের না হয়ে সবাই আলাদা আলাদাভাবে। হোস্টেলের গেট রাত আটটার দিকে বন্ধ করে দেয়া হয় কাজেই ঠিক সন্ধ্যার দিকে বের হলে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ঘর থেকে বের হয়ে হোস্টেলের পিছন দিকে চলে যাবে, সেখানে দেয়াল বেয়ে উঠে দেয়াল টপকে স্কুল থেকে বের হয়ে যাবে। বিছানার একটা চাদর পাকিয়ে দড়ির মতো তৈরি করা হবে, প্রথমে যে পার হবে সে সেটা দেয়ালের অন্যপাশে ধরে রাখবে যেন অনারা সেটা ধরে তাড়াতাড়ি ওঠে পার হতে পারে। ওরা একজুন একজন করে পালাবে। তাই যদি কেউ ধরা পড়ে যায় কখনোই অন্যদের কথা বলবে না। যদি কোনো কারণে ওরা আলাদা হয়ে যায় তাহলে স্কুলের বাইরে যে রাস্তা আছে সেই রাস্তার শেষ মাথায় যে বাস স্টেশন রয়েছে সেখানে অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করবে। যেহেতু পুরো ব্যাপারটা একটা সত্যিকারের এডভেঞ্চার তাই সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে বের হবে। তাদের পায়ে থাকবে টেনিস সু এবং পরনে থাকবে প্যান্ট এবং টী সার্ট। সবার সাথে একটা করে কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়ার মতো ব্যাগ থাকবে, সেই ব্যাগের মাঝে থাকবে আরো এক সেট কাপড়, একটা চাদর, কাগজপত্র, কিছু শুকনো খাবার, ছুরি চাকু বা কোনো এক ধরনের অস্ত্র। যার কাছে যে পরিমাণ টাকা পয়সা আছে সেটা নিয়ে নেয়া হবে, কখন কী প্রয়োজন হতে পারে সেটা কেউ জানে না। অনেক আলোচনা করে ঠিক করা হল প্রথমে বের হবে মিতুল। মিতুলের পর রুনু। রুনুর পর ঝুনু। ঝুনুর পর নিতু, নিতুর পর রেবেকা এবং সবার শেষে তানিয়া। নিতুর ব্যাগের মাঝে থাকবে ফাইলটা—-কাজেই সে যেন ঠিক ভাবে পালিয়ে যেতে পারে সেই ব্যাপারটা সবাই আলাদা করে লক্ষ্য রাখবে।
বাকি দিনটুকু উত্তেজনার মাঝে কেটে গেল। শান্তা আপা আসার আগে ছুটির দিনগুলি ছিল আনন্দে ভরপুর, প্রতিদিন কিছু না কিছু হত। কোনোদিন স্কুলের মাঠে বনভোজন কোনোদিন মজার কোনো বই পড়া কোনোদিন নাটকের রিহার্সাল। অথচ আজকে সবাইকে দিয়ে বাথরুম আর টয়লেট পরিষ্কার করিয়ে ঘরের মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে নোটিশ এসেছে যে সবাইকে চার পৃষ্ঠা ইংরেজি ট্রান্সলেশান করে কুড়িটা অংক করতে হবে। সবাই ঘরে বসে বসে সেগুলি করছে, নিতু এবং তার বন্ধুরা ছাড়া। যখন এই কাজগুলি জমা দেয়ার কথা তার অনেক আগেই তাদের স্কুল থেকে পালিয়ে যাবার কথা। যদি পালাতে না পারে আর খোরাসানী ম্যাডামের হাতে ধরা পড়ে যায় তাহলে ম্যাডাম এমনিতেই খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলবে, কাজেই এই চার পৃষ্ঠা ট্রান্সলেশান আর কুড়িটা অংক না করার জন্যে আলাদা করে শাস্তি পেতে হবে না।
ঠিক সন্ধেবেলা মিতুল তার ব্যাগ কাধে নিয়ে রেডি হল! চাদর পাকিয়ে যে দড়িটা তৈরি করা হয়েছে সেটা হাতে নিয়ে সে কেমন যেন ভীত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ভয় করছে।
সবারই ভিতরে ভিতরে ভয় করছিল কিন্তু মিতুল মুখে সেটা উচ্চারণ করে ফেলার পর হঠাৎ করে সবাই যেন সেটা প্রথমবার টের পেলো। নিতু সাহস দেয়ার জন্যে বল্ল, ভয়ের কী আছে? একবার চিন্তা করে দেখ, ফাইলটা আমার যদি কোনোভাবে বাইরে নিয়ে শান্তা আপার হাতে দিতে পারি তাহলে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হবে?
হুঁ। রুনু বলল, আর ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। যেটা করতে ভালো লাগে সেটা করতে পারব।
মিতুল ফিস ফিস করে বলল, তবু ভয় লাগে।
রেবেকা বলল, ভয়ের কিছু নেই। আয় কাছে আয়, তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে তার বুকে ফুঁ দিয়ে দিই, তাহলে কোনো বিপদ তোকে ছুঁতে পারবে না।
মিতুল রেবেকার কাছে এগিয়ে গেল, তখন রোবক চোখ বন্ধ করে খুব গম্ভীর মুখে তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে মিতুলের বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, যা আর কোনো ভয় নাই। আমার বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যখন পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করতে যেতেন সব সময় তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে যেতেন। তাই কোনোদিন কোনো গুলি লাগে নাই।