ওরা ধীরে ধীরে বই খাতা কাগজ পত্রগুলো বের করতে থাকে। প্রথম বইটি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। বইয়ের ভেতরের পৃষ্ঠায় নাম লেখা বেগম জোহর। কামাল। ওরা আরো একটা বই বের করল এই বইটার নাম তিথিডোর, লেখকের নাম বুদ্ধদেব বসু। এই বইটার উপরেও নাম লেখা বেগম জোহরা কামাল। ওরা আরো কয়েকটা বই বের করল, একটা ইংরেজি বই, নাম দা জাংগল বুক, লেখকের নাম রুডইয়ার্ড কিপলিং। একম আরো বেশ কিছু বাংলা আর ইংরেজি বই। তার নিচে কয়েকটা ডাইরি। পাতা পুরানো হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভিতরে গোটা গোটা হাতে লেখা, কোনো পৃষ্ঠায় একটা ছোট কবিতা, কোনো পৃষ্ঠায় একটা ছোট লিস্ট, কোনো পৃষ্ঠায় একটা দিনের বর্ণনা, আবার কোনো পৃষ্ঠায় একটা চিঠির অংশ। ডাইরিগুলো সরিয়ে তারা আরো কিছু খাতা পেল। গোটা গোটা হাতে সেই খাতায় অনেক কিছু লেখা, মনে হয় গল্প বা উপন্যাস। এবারে নিতু আর তার বন্ধুদের আশাভঙ্গ হতে শুরু করেছে। পুরো বাক্সটাই হচ্ছে বেগম জোহরা কামাল নামের একজন ভদ্রমহিলার বই, কাগজপত্র, লেখালেখির নমুনা আর ডাইরি। ভদ্রমহিলা যেসব বই পড়তেন বা যেভাবে লেখা লেখি করেছেন সেটা দেখে মনে হয় তিনি মানুষটা বেশ জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন কিন্তু এত বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই বাক্সটা খুলে তার ব্যক্তিগত কাগজপত্র বের করে কী লাভ হল তারা বুঝতে পারল না। সত্যি কথা বলতে কী নিতু আর তার বন্ধুদের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। তারা এবারে দ্রুত বাক্স হাতড়ে কাগজপত্রগুলো বের করতে থাকে। একটা চিঠির বাণ্ডিল বের হল। বেশ কিছু খবরের কাগজ বের হল, একটা এলবাম সেখানে অনেকগুলো পারিবারিক ছবি, সবগুলো, ছবি সাদা কালো তখন নিশ্চয়ই রঙিন ছবি ছিল না। ওদের এখন ছবি দেখার সময় নেই তাই সেগুলো সরিয়ে রেখে অন্যান্য জিনিসগুলো বের করতে থাকে। ছোট একটা। টিনের কৌটা, তার মাঝে কিছু টাকা পয়সা একটা আংটি, কয়েকটা তেতুলির বিচি আর কয়েকটা কড়ি। ওরা বাক্সের নিচের দিকে চলে গেছে আর সেরকম কিছু নেই, আরো কিছু খবরের কাগজ, কয়েকটা ম্যাগাজিন একেবারে নিচে একটা ফাইল। ফাইলটা খুলে দেখা গেল অফিসের জাগজপত্র যেরকম হয় ঠিক সেরকম কিছু কাগজ পত্র।
ঝুনু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই?
রেবেকা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খোলা বাক্স আর তার ভিতর থেকে যেসব জিনিস বের হয়েছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল, এত কষ্ট করে বাক্সটা বের করলাম, তার ভিতরে এই সব ব্যবহারী জিনিস?
নিতু বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন মানুষের ব্যবহারী কাগজপত্র কেন এত কষ্ট করে লুকিয়ে রাখা হবে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
মিতুল জানতে চাইল, কী কারণ?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
যাই হোক—এডভেঞ্চার তো শেষ হয়েছে, এখন চল ঘরে ফেরত যাই।
চল। সবাই উঠে দাঁড়াল এবং তখন হঠাৎ করে তাদের মনে পড়ল শান্তা আপার এই ঘরটিতে বাইরে থেকে তালা দেয়া রয়েছে। রুম খানিকক্ষণ পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে এবং আরেকবার খোঁজ নিতে না আসা পর্যন্ত তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।
সবাই খুব মন খারাপ করে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে অপেক্ষা করতে শুরু করে। ঝুনু এলবামটাতে ছবি দেখতে থাকে, তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে মিতুলও ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকদিন আগের ছবি, দেখে কেমন যেন অবাক লাগে। রেবেকা ডাইরিটা পড়তে থাকে, অন্য একজন মানুষের ব্যক্তিগত ডাইরি পড়তে কেমন জানি সংকোচ হয় শুধু মনে হয় একটা অন্যায় কাজ করা হচ্ছে। তানিয়া বইগুলি দেখছে, নিতুও বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখে আবার ফাইলটা টেনে নিয়ে ভিতরের রাখা অফিসের কাগজপত্রের মতো দেখতে কাগজগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো চমকে উঠল চাপা স্বরে চিৎকার করে বলল, দেখ।।
সবাই মাথা তুলে তাকাল, কী?
বেগম জোহরা কামালের দলিল।
দলিল?
হ্যাঁ।
এই দেখ, স্ট্যাম্পের মতো কাগজ, এই দেখ কতগুলো সই। এটা হচ্ছে স্কুলের দলিল।
স্কুলের দলিল?
হ্যাঁ, এই দেখ আরো কাগজপত্র। সব স্কুলের কাগজ পত্র। এই দেখ এখানে কী লেখা—
কী লেখা?
নিতু পড়ে শোনাতে থাকে, আমি নয়নপুর নিবাসী বেগম জোহরা কামাল আমার সকল সম্পত্তি মেয়েদের একটি আদর্শ স্কুল তৈরি করার জন্যে দান করে গেলাম। কোনো অবস্থাতেই এই স্কুলের নামটি আমার নামানুসারে করা যাবে না তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে, শিক্ষার জন্যে সাহিত্যের জন্যে বা দেশের মানুষের অধিকারের জন্যে ত্যাগ করেছেন, দেশের প্রয়োজনে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এরকম একজন মহিলার নামে এই স্কুলের নামকরণ করতে হবে।
নিতু এইটুকু পড়ে থামল, বলল, দেখলি?
বুতুরুনেসা কী সে রকম মহিলা?
না। মিতুল চাপা স্বরে বলল, জানিস না বুতুরন্নেসা কে?
কে?
খোরাসানী ম্যাডামের নানী।
বুতুরুন্নেসা কী জাতির জন্যে নেতৃত্ব দিয়েছে?
কক্ষনো না।
তাহলে?
মিতুল বলল, আগে পড় বাকিটা।
নিতু পুরো কাগজগুলো দেখে বলল, পুরোটা পড়তে অনেকক্ষণ লাগবে, এই স্কুলটা কেমন হবে সবকিছু লেখা আছে। এই দ্যাখ—এই স্কুলটির আবাসিক অংশটিতে মেয়েদেরকে গভীর ভালবাসায় লালন করতে হবে যেন তারা অনুভব করতে পারে যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে ভালবাসা। তাদেরকে শারীরিক শাস্তি দূরে থাকুক কখনো তিরস্কারও করা যাবে না। নিতু পড়া বন্ধ করে বলল, দেখলি? দেখলি কি লেখা?