শান্তা আপা যদি কখনো বাইরে যেতেন তাহলে তালা মেরে চাবিটা জানালার ওপর একটু আড়াল করে রেখে যেতেন, সব মেয়েরাই সেটা জানে। শান্তা আপা নিজেই মাঝে মাঝে কাজ করতে করতে কোনো একটা মেয়েকে বলতেন তার ঘর খুলে কিছু একটা নিয়ে আসতে। কাজেই শান্তা আপার ঘরে ঢোকা খুব কঠিন কিছু নয়। রুনুকে বাইরে রেখে অন্য সবাই ভিতরে ঢুকে গেল, রুনু বাইরে থেকে আবার তালা মেরে দিল, হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম এসে গেলে যেন বুঝতে না পারে শান্তা আপার ঘরে কেউ আছে।
রুনু যখন একা তাদের ঘরটা পরিষ্কার করছে তখন অন্য সবাই শান্তা আপার ঘরের ভিতরে কাজে লেগে গেল। ঘরের মাঝামাঝি দেয়ালের সাথে লাগানো ধাপটার একটা ছোট সুন্দর কার্পেট বিছিয়ে শান্তা আপা খুব সুন্দর একটা বসার জায়গা তৈরি করেছেন। ওরা সেটা সরিয়ে ধাপটা বের করে নিল। রান্নাঘর আর স্টোর রুম খুজেঁ একটা বড় ক্রু ড্রাইভার, একটা হাতুরি আর একটা বটি পাওয়া গেল। এগুলো দিয়েই তারা কাজ শুরু করে দেয়। এক পাশে প্যালেস্তারা খসে খানিকটা জায়গা বের হয়ে আছে সেখানে কে তারা পুরোটা বের করে আনতে শুরু করে। খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছিল, হঠাৎ করে বেশি শব্দ হয়ে গেলে অন্যেরা সন্দেহ করতে পারে। ভিতরে যে পাঁচজন আছে তাদের মাঝে একজন সবসময় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সে একটা সংকেত দিত এবং অন্য সবাই কাজ থামিয়ে ফেলত।
ধাপের ভেতর লুকিয়ে থাকা বাক্সটা বের করা প্রথমে একটা দুঃসাধ্য কাজ বলে মনে হল। ঠিক কী ভাবে কাজ শুরু করলে কাজটা সহজ হবে সেটাও তারা বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠুকে ঠুকে ওপরের প্যালেস্তারাটা সরিয়ে ফেলাই একমাত্র উপায় বলে মনে হওয়ার পর একজন হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ফাটল তৈরি করতে শুরু করে লাগল, অন্যেরা খুচিয়ে খুচিয়ে সেটা তুলে ফেলতে লাগল। ঘণ্টা খানেক কাজ করার পর কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেল, স্কু ড্রাইভারের ফলা দিয়ে বাক্সের ওপর চাড় দিতেই একসাথে অনেকটুকু খুলে আসতে থাকে। ভেতরের বাক্সটা এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই বাক্সের ভেতরে একটা মেয়ের মৃত্যুদেহু থাকতে পারে ভেবে তাদের বুকের ভিতরে কেমন জানি শির শির করতে থাকে। আরো ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর পুরো বাক্সটা বের হয়ে আসে।
সেটাকে ধরাধরি করে বের করে আনা মাত্রই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তানিয়া হঠাৎ চাপা স্বরে বলল, সাবধান।
সবাই যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তানিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, রক্তশূন্য মুখে অন্যদের দিকে বলল, খোরাসানী ম্যাডাম।
তানিয়া জানালা থেকে সরে আসে যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়। একটু পরেই তারা গুম গুম পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল এবং পায়ের শব্দ ঠিক শান্তা আপার ঘরের সামনে এসে থেমে গেল। নিতু এবং তার বন্ধুদের হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চায়। তারা নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে খোরাসানী ম্যাডামের গলার আওয়াজ শোনা গেল, শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণাটাকে দূর করা গেছে।
যন্ত্রণা বলতে নিশ্চয়ই শান্তা আপাকে বোঝাচ্ছে। সাথে নিশ্চয়ই জমিলার মা আছে কারণ তার গলা শোনা গেল, জি মাডাম। যন্ত্রণা গেছে। আপদ বালাই দূর হইছে। একটু থেমে যে কথাটা বলল শুনে ভিতরে সবাই একেবারে চমকে উঠে, ঘরটা খুলবেন না ম্যাডাম?
চাবি এনেছিস?
চাবি তো নাই ম্যাডাম।
খোরাসানী ম্যাডাম তালা ধরে বলল, এই তালা খুলতে আবার চাবি লাগে নাকি? একটা লাথি দিলেই খুলে যাবে।
দিবেন একটা লাথি?
ভিতরে সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে রইল, শুনতে পেল কয়েক মুহূর্তে পরে খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, নাহ! এই মহিলা সাংঘাতিক বড় যন্ত্রণা। দেশের সব আইন কানুন জানে। তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলে আবার না কেস ফেস করে দেয়। যন্ত্রণা হবে।
জমিলার মা জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছে এখন?
ঠিক জানি না। রাত্রে চিঠি পাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। খুব সকাল বেলা বের হয়ে গেছে। খোঁজ নেওয়ার জন্যে লোক লাগিয়েছি।
দরজার বাইরে খোরাসানী ম্যাডাম আর জমিলার মা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে শোনা গেল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, আয় যাই। শয়তানের ঝাড় গুলিরে একটা দাবড়ানি দিয়ে আসি।
জমিলার মা বলল, ম্যাডাম, এত মানুষ দেখেছি জীবনে, কিন্তু আপনার মতো দাবড়ানি আর কেউ দিতে পারে না।
ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে খোরাসানী ম্যাডাম বলল, দাবড়ানীর তুই দেখেছিস কী? এখনও তো শুরু করলামই না?
ঘরের ভেতরে সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে শুনতে পায় গুম গুম করে পা ফেলে খোরাসানী ম্যাডাম চলে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে তারা আবার বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ল। এটা খুলে ভিতরে কী দেখা যাবে কে জানে। যে ভাবে এটাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এর মাঝে কোনো না কোনো রহস্য নিশ্চয়ই আছে। কাঠের বাক্সের ঢালাটাতে একটা ছোট তালা লাগানো ছিল, দীর্ঘদিনে জংধরে সেটা জীর্ণ হয়ে গেছে, হাত দিয়ে ঝাকুনী দিতেই খুলে গেল! বাক্সের তালা ধরে টেনে খোলার আগে নিতু সবার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলর যদি ভিতরে একটা কংকাল থাকে কেউ ভয় পাবি না তো?
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, তারা ভয় পাবেন এবারে সাবধানে ঢালাটা ধরে টেনে উপরে তোলার চেষ্টা করে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ঢালাটা খুলে যায়, ভেতর থেকে এক ধরনের ভ্যাপসা চোটকা গন্ধ বের হয়ে আসে। সবাই ভয়ে ভয়ে ভিতরে তাকাল, সেখানে কোনো কংকাল নেই—আছে কিছু বই, খাতা, কাগজ পত্র, কিছু ব্যবহারের জিনিস। নিতু সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, যদিও মুখে কংকালের কথা বলছিল কিন্তু সত্যি সত্যি একটা কংকাল বের হয়ে গেলে কী করত কেউই জানে না।