বুতরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আর কিছু থাকুক কী না থাকুক, এখানে একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলার যদি কেউ উনিশ-বিশ করে তাকে এই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। খোরাসানী ম্যাডাম দাতের ফাঁক দিয়ে হুশশ করে একটা নিশ্বাস টেনে বলল, তোদের সেই হতভাগা হোস্টেল সুপারিনটেন্টেকে তাই এখান থেকে বের করে দিয়েছি। গরিলারা যেভাবে বুকে থাবা দেয় খোরাপানী ম্যাডাম সেইভাবে থাবা দিয়ে বলল, আমি ম্যাডাম খোরাসানী। আমি এই স্কুল চালাই যারা আমার কথা শুনে না এই স্কুলে তাদের জায়গা নাই। যন্ত্রণা যেটা ছিল সেটা দূর হয়েছে। আৰাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী ইজ আউট। সে আর এই খানে ফেরত আসবে না। এখন আমি একজন একজন করে তোদের সিধা করব। তাদের চামড়া ছিলে সেই চামড়া দিয়ে আমি ডুগডুগি বাজাব।
খোরাসানী ম্যাডাম সবগুলো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত দাঁত ঘষে আবার হুংকার দিয়ে বলল, আমি সব খবর রাখি। সব খবর। এই হোস্টেলে নাকি বার্থডে পার্টি হয়। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ ভেংচে বলল, বার্থ-ডে-পার্টি! আমি দেখব সেই বার্থ-ডে পার্টি কে করে। বার্থ ডে না—ডেথ ডে হবে এখন থেকে। খুন করে ফেলব আমি। খুন!
নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল, ভয় নয় হঠাৎ কেমন জানি ভয়ংকর রাগে নিতুর শরীরে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠতে থাকে।
এখানে নাকি গানের আসর হয়। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ খিচিয়ে বলল, গী-নে-র আ-স-র। আমি গানের আসর করা বের করব।দেখব, গানের আসর কেমন করে হয়। সবাইকে দিয়ে আমি যদি মড়া কান্নার আসর না বসাই তাহলে আমি ম্যাডাম খোরাসানী না। তোদের বাবা মা তোদের চায় না। তোদের ভাইবোন তোদের চায় না। তোদের আত্মীয় স্বজনও তাদের চায় না, তাই তোদেরকে এই খানে দিয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে তোদের কোনো জায়গা নাই। যদি সিধা হয়ে না থাকিস তাহলে এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়েও তোদের জায়গা হবে না। আমি খুন করে তোদের মাটিতে পুঁতে ফেলব। খোরাসানী ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হয়?
সবাই চুপ করে রইল, তখন খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, বিশ্বাস-হ-য়?
সবাই সমস্বরে বলল, হয় ম্যাডাম।
হ্যাঁ। বিশ্বাস হয়। না হয়ে উপায় নাই — এইভাবে এক সুরে খোরাসানী ম্যাডাম পাকা পায়তাল্লিশ মিনিট গালাগালি করে গেল। নিতু এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকে, একজন মানুষ কী রকম করে এতো হৃদয়হীন আর নিষ্ঠুর হতে পারে? নিজের চোখে না দেখলে নিতু কখনো বিশ্বাস করত না যে একজন মানুষ তাদের মতো বাচ্চা মেয়েদের এত ঘেন্না করতে পারে। তারা কী সত্যিই এত খারাপ?
গালাগাল শেষ করে খোরাসানী ম্যাডাম সবাইকে নিজের ঘরে পাঠাল। সবাইকে প্রথমে নিজের ঘর পরিষ্কার করে তারপর বাথরুম এবং টয়েলট পরিষ্কার করতে হবে। এটা হচ্ছে তাদের শাস্তির শুরু, দুপুরের খাবারের পর নাকি সত্যিকারের শাস্তি শুরু হবে।
কেউ একটি কথা না বলে মাথা নিচু করে নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে শুরু করল। শান্তা আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় মিতুল নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, শান্তা আপার কী হয়েছে মনে হয়?
রেবেকা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে হয় খুন করে ফেলেছে।
সবাই চমকে উঠে রেবেকার দিকে তাকল, নিতু বলল, কী বলছিস তুই?
শান্তা আপা কী কখনো আমাদের কিছু না বলে চলে যাবেন?
সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না।
তাহলে?
নিতু বলল, শান্তা আপা হয়তো কোনো কাজে গেছেন, চলে আসবেন আবার।
তানিয়া গম্ভীর গলায় বলল, খোরাসানী ম্যাডাম কোনো একটা ফন্দি করে শান্তা আপাকে বহিরে পাঠিয়েছে। এখন গেট বন্ধ করে রাখবে শান্তা আপাকে আর ঢুকতে দেবে না।
নিতু শান্তা আপার ঘরের বন্ধ দরজায় ঝোলানো তালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, যদি শান্তা আপা আর ফিরে না আসে তাহলে আমাদের সবার জীবন শেষ।
মিতুল মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ জীবন শেষ।
একজন একজন করে খুন করে আমাদের পুঁতে ফেলবে। পৃথিবীর কেউ আর খোঁজ পাবে না।
কেউ খোঁজ পাবে না?
নিতু হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, খোরাসানী ম্যাডামকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া যায় না?
পুলিশের কাছে?
হ্যাঁ।
কেন?
সে যে মেয়েদেরকে খুন করেছে।
সবাই মাথা নাড়ল, কারো মনে এ ব্যাপারে একটু সন্দেহ নেই। রুনু দুর্বল গলায় বলল। কিন্তু তার প্রমাণ কই?
নিশ্চয়ই প্রমাণ আছে। খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কোথায় খুঁজৰি?
রেবেকা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, মনে নাই শান্তা আপার ঘরে একটা ধাপের মতো আছে, ভিতরে একটা বাক্স।।
সবাই চোখ বড় বড় করে রেবেকার দিকে তাকাল। মিতুল বলল, কিন্তু শান্তা আপাকে না বলে সেটা খুলবি?
শান্তা আপা কিছু মনে করবেন না।
নিতু বলল, মনে নাই শান্তা আপা বলেছিলেন যখন এডভেঞ্চার করার ইচ্ছা করবে তখন সেটা খোলা হবে?
এখন কী এডভেঞ্চার করার ইচ্ছা করছে?
এর থেকে বড় এডভেঞ্চার আর কী হতে পারে? আমাদের একজন একজনকে মেরে পুতে ফেলবে ম্যাডাম নিজে বলেছে।
তা ঠিক।
তাহলে দেরি করে কাজ নেই, আয় কাজ শুরু করে দিই।
যখন সব মেয়েরা নিজেদের ঘর পরিষ্কার করে বাথরুম পরিষ্কার করছিল তখন নিতু আর তার বন্ধুরা শান্তা আপার ঘরে ঢুকে গেল। শান্তা আপা সাধারনত তার ঘরে তালা লাগাতেন না, এটা খোলাই থাকত। মেয়েরা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমার ঘরে কী ই বা আছে নেয়ার মতো! আর হোস্টেলের মেয়েরা চারপাশে থাকলে চোর ডাকাতের সাহস হবে কাছে আসার?