গানের আসর শেষ হতে হতে মাঝ রাত হয়ে গেল, চাদটা যখন মাথার উপর উঠে গেছে বারান্দায় আর জ্যোৎস্নার আলো নেই তখন শান্তা আপা সে দিনের মতো আসর শেষ করলেন। কথা থাকল এখন থেকে প্রতি রাতে এরকম গানের আসর বসবে।
মেয়েরা আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করল, শান্তা আপাও খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন। সবার শেষে শান্তা আপা দুটি গান গেয়ে শোনালেন আর সেটা শুনে মিতুল শান্তা আপাকে বলল, আপা।
কী মিতুল?
আপনি আমাকে গান শেখাবেন?
শান্তা আপা খিল খিল করে হেসে বললেন, আমি তোমাকে কেমন করে শেখাব? আমি কী কিছু জানি? তোমাকে গান শেখাবে সত্যিকারের গানের ওস্তাদ।
মিতুল ম্লান মুখে বলল, কিন্তু আপা, আমি ওস্তাদ কোথায় পাব?
তোমাকে পেতে হবে কে বলেছে? তোমার জন্যে ওস্তাদ আমি খুঁজে বের করব। এই শহরে সবচেয়ে ভালো যে গানের ওস্তাদ আছে সে তোমাকে গান শেখীবে, তারপর শেখাবে যে দেশের মাঝে সবচেয়ে ভালো ওস্তাদ সে! বুঝেছ?
মিতুল মাথা নাড়ল। শান্তা আপা বললেন, কেন তোমার জন্যে আমি সবচেয়ে ভালো ওস্তাদ খুঁজে বের করব জান?
কেন আপা?
কারণ তুমি যখন সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত গায়িকা হবে তখন যখন বিবিসি থেকে তোমার ইন্টারভিউ নেয়া হবে সেখানে সাংবাদিকরা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি কেমন করে গান গাইতে শিখেছ, তখন তুমি আমার কথা বলবে! আর আমিও তখন বিখ্যাত হয়ে যাব।
আশে পাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা বলল, আমরা তাহলে কেমন করে বিখ্যাত হব আপা?
নিতু হি হি করে হেসে বলল, আমরা একদিন মিতুলকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিই আপা, তাহলে বলতে পারব আমরা বিশ্ববিখ্যাত গায়িকাকে পিটিয়েছি।
সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শান্তা আপাও।
শান্তা আপী নিজের ঘরে এসে দেখলেন তার ঘরের দরজায় একটা চিঠি রাখা আছে। সবাই মিলে যখন জ্যোৎস্নার আলোয় বসে গান গাইছিল তখন কেউ একজন এসে তার দরজায় এই চিঠিটা রেখে গেছে। শান্তা আপা চিন্তিত মুখে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, আলো জ্বেলে খাম খুলে চিঠিটা বের করলেন, ভিতরে একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, খোরাসানী ম্যাডাম লিখেছে। চিঠি লিখে সে জানিয়েছে স্কুল বোর্ড থেকে তাকে দেয়া ক্ষমতার বলে এই স্কুলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে শান্তা চৌধুরীকে বরখাস্ত করা হল। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে তাকে স্কুল ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হবে।
শান্তা আপা তার বিছানায় গিয়ে বসলেন, কয়দিন থেকেই তার মনের ভিতরে এরকম একটা সন্দেহে দানা বেঁধে উঠছিল।
১০. বেগম জোহরা কামাল
ভোরবেলা হোস্টেলের মেয়েরা ভয়াবহ আতংকে জেগে উঠল, অনেকদিন পর হঠাৎ করে শুনতে পেল বারান্দায় গুম গুম শব্দ করে খোরাসানী ম্যাডাম হাঁটছে এবং হাঁটতে একেকটা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় একটা লাথি মেরে হুংকার দিয়ে বলছে, দশ মিনিটের মাঝে মাঠে। নাহলে জবাই করে ফেলব।
নিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠে, শান্তা আপা আসার পর থেকে তাদেরকে বুক আগলে খোরাসানী ম্যাডাম থেকে রক্ষা করে এসেছেন এখন হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম ফিরে এসেছে, তার মানে কী? তাহলে কী শান্তা আপার কিছু হয়েছে? শান্তা আপা কী হাসপাতালে? একসিডেন্ট হয়েছে? নাকি খোরাসানী ম্যাডাম খুন করে তার ডেডবডি কোথাও পুতে ফেলেছে? নিতু ভয়ার্ত মুখে অন্যদের দিকে তাকায়, সবাই ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে, হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে তাদের বুঝি কোনো প্রিয়জন মারা গেছে এবং তারা কী করবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম বলেছেন দশ মিনিটের মাঝে মাঠে হাজির হতে হবে, তাই কেউ আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোরও সময় পেল না। দৌড়াদৌড়ি করে বিছানা থেকে উঠে যে যেভাবে পারে কোনোরকমে ঘুমের পোশাক ছেড়ে অন্য কিছু একটা পরে মাঠের দিকে ছুটল। শান্তা আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সবাই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে বন্ধ দরজার দিকে তাকাল, সেখানে একটা তালা ঝুলছে। ঘর ছেড়ে যাবার সময় শান্তা আপা প্রায় সব সময় তার দরজা খোলা রেখে যেতেন। মাঝে মাঝে ঘর বন্ধ করে যেতে হলে শান্তা আপা এই তালাটি লাগিয়ে যেতেন। চাবি কখনো সাথে নিতেন না জানালার কাছে আড়াল করে রেখে যেতেন সব মেয়েরা সেটি জানত। ঘরে তার তালাটি লাগানো কাজেই শান্তা আপা নিশ্চয়ই তার ঘরের তালা মেরে কোথাও গিয়েছেন। কিন্তু কোথায়?
সব মেয়ে ভয়ার্ত এবং পাংশু মুখে মাঠে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়েছে তখন গুম গুম করে হেঁটে খোরাসানী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কোমরে হাত দিয়ে খোরাসানী ম্যাডাম একটা জেনারেলের মতো দাঁড়াল, তার ঠিক পিছনেই জমিলার মা এসে দাঁড়িয়েছে, আজকে তাকে দেখতেও আমরি সুবদোরের মতো দেখাচ্ছে। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, হতচ্ছাড়া পাজী, বদমাইস শয়তানের ঝাড়।
সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। খোরাসানী ম্যাডাম সবার দিকে তাকিয়ে আবার খেকিয়ে উঠল, আরশোলার বাচ্চা, নোংরা ইঁদুর, হুকওয়ার্মের ছাও।
নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল। গালাগালির মাঝেও কী এই দানবটি একটু সমবেদনা দেখাতে পারে না?
খোরাসানী ম্যাডাম হতে দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, তোদের দিন শেষ। এখন তাদের জবাই করব। একজন একত্র করে। জবাই করে চামড়া ছিলে ফেলব। বুঝেছিস?
সবাই চুপ করে রইল খোরাসানী ম্যাডাম তখন আকাশ ফাটিয়ে হুংকার দিল, বুঝেছিস?
সবাই তখন ভয় পেয়ে একসাথে বলল, বুঝেছি, ম্যাডাম।