পার্টি শেষ হবার পর নিতুদের ঘরটার যা একটা আবস্থা হল সেটি আর বলার মতো নয়, সেটা পরিষ্কার করতে গিয়ে সবার প্রায় বারটা বেজে যাবার মতো অবস্থা। নিতুর জন্মদিন বলে কেউ তাকে হাত লাগাতে দিচ্ছি না কিন্তু তবুও সে জোর করে সবার সাথে হাত লাগালো। সব কয়জন মেয়ে তার জন্যে এমন চমৎকার একটা জন্মদিনের উৎসব করেছে, সে কেমন করে এখন এই কাজ থেকে পিছিয়ে থাকে?
বেশ কয়দিন পরের কথা, সন্ধে বেলা সবাই পড়তে বসেছে এরকম সময় শান্তা আপা এসে হাজির হলেন। সবাই পড়ার টেবিল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে শান্তা আপাকে ঘিরে দাঁড়াল। শান্তা আপা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হচ্ছে তোমাদের পড়াশোনা?
সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলল, পড়তে ইচ্ছে করছে না আপা।
তাহলে কেমন করে হবে। ইচ্ছে করুক আর নাই করুক, সবাইকে পড়তে হবে।
নিতু মুখ কাচু মাচু করে বলল, প্রত্যেক দিনই তো পড়ি।
শান্তা আপা এসে নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে আজকে যদি সবাই মন দিয়ে পড়াশোনা কর তাহলে রাত্রি বেলা একটা মজা করতে পারি।
সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। রেবেকা জিজ্ঞেস করল, কী মজা আপা?
আজকে হচ্ছে পূর্ণিমা। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার তাই রাত্রি বেলা দেখবে কী চমৎকার জ্যোৎস্না হবে। সেই জ্যোৎস্নার আলোতে আজ রাতে গানের আসর হবে। তোমরা গান গাইতে পার তো?
পারে আপা পারে। মিতুল পারে।
ভেরি গুড। এখন পড়তে বসে যাও। আমি রুমে রুমে গিয়ে সবাএক বলে আসি।
সেদিন রাত্রিবেলা যখন সবার ঘুমিয়ে যাবার কথা তখন সবাই এসে বারান্দায় গোল হয়ে বসেছে। হোস্টেলের সব কয়টি লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে তাই শুধু মাত্র জোৎস্নার নরম আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। নিতু অবাক হয়ে জ্যোৎস্নার আলোর দিকে তাকিয়ে রইল কতবার নিশ্চয়ই এখানে পূর্ণিমা এসেছে এবং চলে গিয়েছে, কখনো চোখ মেলে দেখে নি, আজ প্রথম দেখছে। জ্যোৎস্নার আলো কী সুন্দর। মনে হয় কেউ একজন অনেক হিসেব করে এই আলোটা তৈরি করেছে, যেন বেশি উজ্জ্বল না হয়ে যায় আবার বেশি অন্ধকারও না হয়ে যায়। দেখে মনে হয় সবকিছু দেখা যাচ্ছে কিন্তু আবার ভালো করে দেখতে চাইলে সবকিছু কেমন যেন আবছা হয়ে যায়। মনে হয় কোনটা কী রং বোঝা যাচ্ছে কিন্তু ভালো করে দেখতে চাইলেই সেটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় সবকিছুকে কোমল একটা কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নিতু অবাক হয়ে জ্যোৎস্নার আলো আর এই আলোতে অন্য সবার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু আগেই যে মেয়েরা চেঁচামেচি হৈ চৈ করছিল চৈ করছিল জ্যোৎস্নার নরম আলোতে এসে তারাই আবার কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। কী আশ্চর্য!
শান্তা আপা মাঝখানে এসে বসে বললেন, একটা হরমোনিয়াম আর তবলা থাকলে কী চমৎকার হত।
কেউ কিছু বলল না, নিতু মিতুলকে গান শেখানোর কথা বলার পর কী ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল সেটা সবার মনে পড়ে গেল কিন্তু এই চমৎকার পরিবেশে সেটা বলতে কারো রুচি হল না। শান্তা আপা বললেন, নাও, কে শুরু করবে?
কেউ কিছু বলল না, তখন শান্তা আপা আবার বললেন, কী হল? এত লজ্জা পেলে কেমন করে হবে? গীও কেউ একজন।
নিতু বলল, আমরা তো গান গাইতে পারি না, শুধু মিতুল পারে।
শান্তা আপা বললেন, মিতুল গাও একটা গান।
মিতুল লজ্জা পেরে বলল, আপা, আমার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি তো কখনো গান গাইতে শিখি নাই, তাই কোনো গান পুরোটা জানি না!
যেটুকু জান সেটুকুই গাও।
মিতুল তখন গান গাইতে শুরু করল, তার গলা থেকে মধুর একটা সুর জ্যোৎস্নার আলোতে ছড়িয়ে পড়ল এবং হঠাৎ করে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিশ্চপ হয়ে গেল। মিতুল যে কয়টা লাইন জানে সেটাই নিজের মতো করে খানিকটা ভুল সুরে এবং অনেক জায়গায় ভুল কথায় গেয়ে শোনাল কিন্তু সেটা শুনেই শান্তা আপা একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন।
গান শেষ হবার পর শান্তা আপা মিতুলকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, কী সর্বনাশ! মিতুল, তুমি এখানে কী করছ? খোদা তোমাকে যে গলা দিয়ে পাঠিয়েছেন তোমার তো বিশ্বজয় করতে হবে।
নিতু বলল, আপা, মিতুল এর মাঝে হোস্টেল জয় করে ফেলেছে।
সেটা কী রকম?
মিতুল ইচ্ছে করলে গান গেয়ে গ্লাশ, লাইট বাল্ব জানালার কাঁচ এসব ভেঙ্গে ফেলতে পারে।
শান্তা আপা অবিশ্বাসের সুরে বললেন, সত্যি?
সত্যি। তখন একাধিক মেয়ে গান গেয়ে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে খোরাসানী ম্যাডাম আর আগের হোস্টেল সুপারেকে জব্দ করার ঘটনাটা শান্তা আপাকে শোনাল। শান্তা আপা হতবাক হয়ে বসে থেকে বললেন, পৃথিবীর কত বড় বড় শিল্পী আছে, তারা সারা জীবন সাধনা করে গলার মাঝে এরকম কন্ট্রোল আনে
আর আমাদের মিতুল এখানে বসে থেকে সেটা করতে পারে? কী আশ্চর্য!
রেবেকা বলল, আসলেই আশ্চর্য আপী। মিতুলের জ্যোৎস্না রাতের গানটা শুনেন, সেটা সবচেয়ে ভালো।
শান্তা আপা মিতুকে বললেন, পাও মিতুল।
মিতুল আবার গাইতে শুরু করল, আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে …
সেই গান শুনে সবার মনে হতে লাগল সত্যিই বুঝি সবাই এই জ্যোৎস্নারাতে বনে চলে এসেছে। এই হোস্টেল, এই স্কুল, মানুষজন সবকিছু মিথ্যা, মিতুল যেটা বলছে সেটাই সত্যি। মিতুল গান গাইতে গাইতে কথা ভুলে যাচ্ছিল তখন শান্তা আপা তাকে সেটা ধরিয়ে দিতে লাগলেন।
গান শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ সবাই চুপ করে বসে রইল, ওদের মনে হতে লাগল মিতুল বুঝি সবাইকে যাদু করে ফেলেছে।