কেঁদো বাঘের বিশাল ভয়ংকর মাথাটা আস্তে আস্তে আবার উঠে যায়। আকাশের কাছাকাছি থেকে আবার একটা গর্জন ভেসে এল, তোর হাতে এইটা কী?
নিতু তার হাতের দিকে তাকাল, দুই হাতে সে শক্ত করে তার ভোটকা মিয়াকে ধরে রেখেছে। সে সেটাকে তুলে এনে বুকে চেপে ধরে বলল, এইটা আমার টেডি বিয়ায়। আমি যখন–
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কেঁদো বাঘের বিশাল মুখ দেখে মাঝখানে তার কথা বন্ধ হয়ে গেল।
তুই যখন?
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা এইটা আমাকে দিয়েছেন।
নিচে ফ্যাল।
নিতু না বুঝে অবাক হয়ে তাকাল তখন সেই পাহাড়ের ভিতর থেকে গর্জন বের হয়ে এল, নি-চে-ফে-লে-দে।
নিতু ভয়ে ভয়ে তার ভোটকা মিয়াকে নিচে ফেলল, সাথে সাথে সেই বিশাল পাহাড় এগিয়ে এসে ফুটবলে যেভাবে কিক দেয় সেই ভাবে ভোটকা মিয়াকে একটা কিক দিল—ভোটকা মিয়া গুলির মতো আকাশে উড়ে গেল। নিতু একটা চিৎকার করে উঠে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইল সেটা কোথায় গিয়ে পড়েছে তখন সেই ধুমসো পাহাড় আবার গর্জন করে উঠল, খবরদার নড়বি না।
নিতু পাথরের মতো জমে গেল।
সামনে তাকা। নিতু সামনে তাকাল।
সীনা টান, মুখ উঁচু। নিতু সীনা টান করে মুখ উঁচু করল।
হাত পাশে, আঙুল মুঠ। নিতু হাত পাশে এনে আঙুল মুঠিবদ্ধ করল।
গোড়ালী জয়েন, মুখ বন্ধ, চোখ খোল। নিতু দুই পায়ের গোড়ালী একসাথে লাগিয়ে মুখ বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে খুলে তাকাল।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাহাড় এবারে স্টীম ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুই কী করেছিস?
নিতু প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না, ভয়ে সে ঠিক করে চিন্তাও করতে পারছিল না, তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, তার মাঝে কোনো ভাবে নিজেকে সামলে বলল, আমি কিছু করি নাই।
কেঁদো বাঘের মতো মুখটা এবারে আবার নিচে নেমে এলো, নিতুর নাকে আবার ভুক করে একটা মাংস পচা গন্ধ এসে লাগে। মুখটা আবার ট্রাঙ্কের ডালার মতো খুলে যায়, ভিতর থেকে ধারালো দাঁত আর লকলকে কালো জিব বের হয়ে আসে, ভেতর থেকে হিস করে আওয়াজ আসে, বল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।
আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।
কেঁদো বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, জো-রে। শব্দের ঝাপটায় মুখ থেকে থুতু বের হয়ে এসে নিতুর মুখে লাগল, ঘেন্নায় নিতুর শরীর স্ত্রী রী করে উঠে কিন্তু সে নড়ল না, ভয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।
কেঁদো বাঘের মাথা আবার ওঠে যায়, নাক দিয়ে আবার ইঞ্জিনের মতো শব্দ হয়, মুখের ডালা খুলে আবার শব্দ বের হয়, নিশ্চয়ই কিছু করেছিস, না হলে এখানে কেন পাঠাল?
নিতু চুপ করে রইল, সত্যি সত্যি তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
কথা বল নর্দমার পোকা, ছারপোকার ছাও।
নিতু ভাঙ্গা গলায় যতটুকু সম্ভব জোরে জোরে বলল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।
আমার সাথে মামদোবাজী? এক দিনে পিটেয়ে সিধা করে দেব। হাড়ি ভেঙ্গে গুড়া করে দেব। চামড়া ছিলে ডুগডুগী বানাব। আমাকে চিনিস না তুই বানরের বাচ্চা বানর? তেলাপোকার ডিম? বল সত্যি কথা।
এবারে নিতু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল, তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি বের হয়ে আসে। ধুমসো পাহাড় আবার হুংকার দিয়ে বলল খবরদার কাঁদবি না, ছিচকাঁদুনে ইঁদুর।
নিতু অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকে ফেলল।
তুই কী মনে করিস আমি কিছু বুঝি না? আমার নাক টিপলে দুখ বের হয়? এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আমি আছি চৌদ্দ বছর। আমি তোর মতো শত শত ছেমড়ী দেখেছি। যাদের স্বভাব ইঁদুরের মতো। চোর ছ্যাচড়ের বাচ্চা। গুণ্ডা বদমাইসের বাচ্চা। আমার হাত দিয়ে বের হয়েছে, আমি টিপে টিপে তাদের ভূড়ি ফাঁসিয়ে দিয়েছি। সাপ হয়ে এসেছে, আরশালা হয়ে বের হয়ে গেছে। দেশের যত পাজী হতছাড়া বেয়াদপ বদমাইস শয়তান মেয়েগুলিকে যখন বাপমা সিধে করতে পারে না তখন তাদেরকে পাঠায় এইখানে। আমি সিধে করে ছেড়ে দেই। তোকেও আমি সিধে করব।
নিতু এবারেও কিছু বলল না, হঠাৎ করে তার চোখের সামনে সারা পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। তার বাবা আর মা মিলে কোথায় পাঠিয়েছে তাকে? কী হবে তার এইখানে?
পাহাড়ের মতো মহিলা এইবারে কাকে যেন ডাকল, জমিলার মা।
সাথে সাথে কোথা থেকে যেন জমিলার মা হাজির হল, বেঁটেখাটো একজন মহিলা মুখ দেখে মনে হয় যেন একটা রবোট। কাছে এসে মিলিটারিদের মতন এটেনশান হয়ে বলল, আমাকে ডেকেছেন মাভাম?
হ্যাঁ। এই নর্দমার পোকা ছারপোকার ছাও, হুক ওয়ার্মকে বি ব্লকে দুইশ কারো নম্বর রুমে দিয়ে আস।
কোন সিটে ম্যাডাম?
গিয়ে দেখ, একটাই সিট খালি আছে।
ঠিক আছে ম্যাডাম।
মুখে কোনো ভাবভঙ্গি নেই বেঁটেখাটো কিন্তু শক্ত টাইপের সেই রবোট মহিলা নিতুর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নিতুকে বলল, চল।
নিতু পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার টেডি বিয়ার, ম্যাডাম।
পাহাড় হুংকার দিয়ে বলল, চোপ। এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে মানুষ ছাড়া আর কিছু থাকতে পারবে না।
কিন্তু ম্যাডাম। এই টেডি বিয়ারটা আমার আম্মা আমাকে দিয়েছিলেন চোপ বেয়াদপ। চোপ। খামোশ। নিতু কী বলবে বুঝতে পারল না। পাহাড় আবার গর্জন করে বলল, যখন এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে বের হবি তখন তোর মাকে বলিস আরেকটা কিনে দিতে।
কিন্তু আমার আম্মা মারা গেছেন। কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে তার মায়ের কথা মনে পড়ে সে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।