নিজেদের রুমের সামনে এসে রেবেকা দাঁড়িয়ে গেল। দরজাটা ভেজানো রেবেকা নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, যা ভেতরে ঢোক?
নিতু একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল, বিকাল বেলা থেকেই রেবেকা কেমন যেন বিচিত্র ব্যবহার করছে, কারণটা কী কে জানে। সে কয়েক মুহূর্ত রেবেকার দিকে তাকিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, সাথে সাথে মনে হল একশ মেয়ে এক সাথে চিৎকার করে উঠল, হ্যা-পী-বার্থ-ডে-নি-তু-উ-উ-উ!
নিতু কিছু বোঝার আগেই ঘরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা মেয়েরা চিৎকার করে বের হয়ে আসে, কাগজের বাঁশি বাজাতে থাকে, হাত তালি দিতে থাকে, শীষ দিতে থাকে এবং অর্থহীন ভাষায় চিৎকার করতে থাকে। নিতু অবাক হয়ে দেখল তাদের ঘরটাকে একটা পার্টির জন্যে সাজানো হয়েছে বিছানাগুলো ঠেলে সরিয়ে মাঝখানে জায়গা করা হয়েছে সেখানে একটা টেবিল। টেবিলে একটা কেক, কেকের মাঝে মোমবাতি জ্বলছে। পিছনে দেওয়ালে কাগজ কেটে লেখা শুভ জন্মদিন—নি। ঘরে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে, ঘরের কোনায় কোনায় বেলুন ঝুলছে।
নিতু হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং হঠাৎ করে তার মনে পড়ল সত্যিই আজ তার জন্মদিন। যখন তার আম্মা বেঁচেছিলেন তখন হৈ চৈ করে তার জন্মদিন করা হয়েছে। এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে জন্মদিনের তারিখটা মনে রাখাটাও নিশ্চয়ই কোনো এক ধরনের অপরাধ বলে বিবেচনা করা হতো। তাই কোনো মেয়ে আর এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। এখন শান্তা আপা আসার পর সব কিছু পাল্টো গেছে, শান্তা আপা ফাইল ঘেটে কবে কার জন্মদিন খুঁজে বের করে সবার জন্মদিন করা শুরু করছেন।
নিতু চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে রইল, কী বলবে বা কী করবে সে বুঝতে পারছিল না, সবগুলো মেয়ে তাকে ঘিরে হৈ চৈ আর চেঁচামেচি করতে থাকে। রেবেকা কেন বিকেল বেলা তাকে নিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করছিল এখন হঠাৎ করে সেটা নিতুর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।
শুভ জন্মদিন নিতু শান্তা আপার গলার স্বর শুনে নিতু ঘুরে তাকাল, শান্তা আপা আজকে কী সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছেন! নিতু শান্তা আপার দিকে তাকিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। শান্তা আপা অবাক হয়ে বললেন, আরে বোকা মেয়ে! একী হচ্ছে! কাঁদছ কেন?
নিতু চোখ মুছে বলল, আপা, আপনি চলে গেলে আমাদের কী হবে? শান্তা আপা অবাক হয়ে বললেন, আমি কেন চলে যাব?
জানি না। নিতু ফোঁপাতে ফেঁপাতে বলল, আমার খালি মনে হয় আপনি চলে যাবেন তখন আমরা আবার একা হয়ে যাব, কেউ আর আমাদের আদর করবে না।
ধুর বোকা! শান্তা আপা নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেন আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব?
আপনি তাহলে কথা দেন কখনো আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না?
শান্তা আপার মুখটা হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়, নিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, সেই কথা কী কেউ কখনো দিতে পারে? তবে আমার নিজের হাতে থাকলে তোমাদের কোনো একটা ব্যবস্থা না করে আমি কোথাও যাব না।
নিতু চোখ মুছল। শান্তা আপা নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এসো এখন কেক কাটতে হবে। কেক কাঁটার পর উপহার খুলবে।
নিতু অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি কেকের পাশে বেশ কয়টা উপহার রঙিন কাগজে মুড়ে রাখা আছে।
ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভানোর আগে মিতুল বলল, তুই মনে মনে একটা কিছু ইচ্ছা করে ফুঁ দে। যদি এক ফুয়ে সব মোমবাতি নিভিয়ে দিতে পারিস তাহলে তোর ইচ্ছা পূরণ হবে।
সত্যি?
সত্যি।
নিতু বুক ভরে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে এক ফুয়ে সবগুলো মোমবাতি নিভিয়ে দিতেই সবাই হাত তালি দিয়ে উঠে। রুনু জিজ্ঞেস করল, কী ইচ্ছা করেছিস রে নিতু?
নিতু ইচ্ছা করেছে যেন শান্তা আপা কখনো তাদের ছেড়ে চলে না যান, কিন্তু সেটা সবার সামনে বলতে তার একটু লজ্জা করল, সে বলল, উহুঁ বলব না। এটা সিক্রেট।
ঝুনু বলল, বুঝেছি। নিশ্চয়ই মনে মনে একটা সুন্দর জামাই চেয়েছে।
ঝুনুর কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। শান্তা আপাও হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতেই বললেন, নিতু এত ভালো একটা মেয়ে সুন্দর একটা বর তো চাইতেই পারে। আর সুন্দর হোক কী না হোক ভালো যেন হয়। ভালো একটা মেয়ের ভালো একটা বর! তাই না নিতু?
নিতু লজ্জায় টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠল। মিতুল নিতুকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে শান্তা আপাকে বলল, আপা, আপনি কাকে ভালো একটা মেয়ে বলছেন? নিতু কী রকম পাজী আপনি জানেন? ও এখন পর্যন্ত কী কী করছে শুনলে আপনার হার্ট এটাক হয়ে যাবে।
রেবেকা বলল, পাজী একটা মেয়ের পাজী একটা বর দরকার।
শান্তা আপা বললেন, উহুঁ। তাহলে তো আরো বেশি দরকার ভালো একটা বরের, যেন দেখে শুনে রাখতে পারে। তাই না নিতু?
বর এবং তার ভালো মন্দের আলোচনা এবং সে কী পরিমাণ পাজী সেই আলোচনায় নিতু একেবারেই মজা পাচ্ছিল না তাই আলোচনা ঘোরানোর জন্যে বলল, আমি কী কেকটা এখন কাটব?
হ্যাঁ হ্যাঁ। মেয়েরা কেকটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কাট কাট।
শান্তা আপা বললেন, তার আগে হ্যাপি বার্থ ডে গান গাইতে হবে। বলে নিজেই শুরু করলেন, তার সাথে সবাই যোগ দিল,
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু নিতু
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ…
সবাই উচ্চ স্বরে চিৎকার করে হাত তালি দিতে থাকে এবং তার মাঝে নিতু কেকটা কাটল। কেক কেটে টুকরো টুকরো করে সবাইকে দেয়া হল, সাথে খাবার জন্যে চানাচুর আর মিষ্টি আনা হয়েছে। তানিয়া আর মিতুল মিলে সবাইকে প্লেট করে খাবার দিতে থাকে। খাওয়া শেষ হবার পর উপহার খোলা হল। শান্তা আপা দিয়েছেন, সত্যজিৎ রায়ের বই। মেয়েরা কেউ দিয়েছে চুলের ক্লীপ, ফিতা আর চকলেটের প্যাকেট। সবচেয়ে সুন্দর যে উপহারটা সেটা হচ্ছে একটা জন্মদিনের কার্ড যেখানে সব মেয়ে কিছু একটা লিখে নিচে নিজের নাম লিখে দিয়েছে। ফুল লতা পাতা পাখি এঁকে সেই কার্ডটা নিজেরাই তৈরি করেছে।