তানিয়া মাথা নাড়ল, বলল, হতে পারে আপা। বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে দুই চারটা মার্ডার নিশ্চয়ই হয়েছে।
শান্তা আপা খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে। যখন আমাদের খুব এডভেঞ্চারের মুড হবে তখন আমরা এই গোপন বাক্সটা বের করে দেখব কী আছে ভেতরে।
ঝুনু ভয় পাওয়া গলায় বলল, আপা —
কী হল?
আপনার ভয় করবে না, ঘরের ভেতরে একটা গোপন বাক্সের ভিতরে হয়তো একটা ডেডবড়ি?
শান্তা আপা খিল খিল করে হেসে বললেন, চারপাশে তোমরা এতগুলি মেয়ে, ভয় করবে কেন? আর যদি খুব বেশি ভয় করে তখন আমি না হয় তোমাদের ঘরে চলে আসব। থাকতে দেবে না?
সবগুলি মেয়ে সমস্বরে চিৎকার করে বলল, দেব আপা দেব।
নিতুদের পাশের ঘরে থাকে—ছোটখাট একটা মেয়ে বলল, আপা, আমাদের আগের হোস্টেল সুপার কিন্তু সত্যি সত্যি ভূতের ভয় পেয়ে চলে গেছেন।
তাই নাকি?
জি আপা। ইঁদুরের ভূত।
নিতু আর তার রুম মেটরা অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রাখল, শান্তা আপা খুব ভয় পেলেন বলে মনে হল না, হাসি মুখে বললেন, ইঁদুরের ভূত হলে সমস্যা নেই। খুঁজে পেতে একটা বিড়ালের ভূত নিয়ে আসব–তাহলেই ধারে কাছে আসবে না।
সবার মনে আনন্দের একটা ফুরফুরে ভার ছিল বলে এই ছোট কথাটিতেই সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে নাগল। ওরা যখন বের হয়ে যাচ্ছে তখন শান্তা আপা ঝুনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি খুব দুঃখিত, যে তুমি আমার ঘরে এসে এরকম ব্যথা পেলে।
মিতুল হি হি করে হেসে বলল, আপা, ঝুনুর কাজই হচ্ছে ব্যথা পাওয়া। আপনার এখানে না হলে নিজের ঘরে ব্যথা পেতো। নিজের ঘর না হলে বাইরে গিয়ে ব্যথা পেতো।
রেবেকা বলল, আর এখন আমাদের সুবিধে হল কে রুনু কে ঝুনু বের করা। এই সপ্তাহে ঝুনু হচ্ছে যার পায়ে ছাল উঠে গেছে সে।
সবার মন ভালো বলে আবার সবাই হি হি করে হাসতে থাকে।
০৯. বিপদের শুরু
ক্লাশ শেষ হবার পর আগে যে রকম দৌড়াতে দৌড়াতে সবার নিজের রুমে এসে আধা ঘণ্টা ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে হলে এখন সেই যন্ত্রণাটা বন্ধ হয়েছে। কেউ চাইলে ঘুমাতে পারে কিন্তু সেটা আর কঠিন নিয়ম নয়—তাই কেউ ঘুমায় না, সবাই মিলে গল্পগুজব করে। বিকেলে নস্তা করে সবাইকে অবিশ্যি মাঠে গিয়ে খেলা ধুলা করতে হয়, সেখানেও নিয়ম পাল্টানো হয়েছে, যার যেটা ইচ্ছা খেলতে পারে। মেয়ে বলেই যে ছেলেদের খেলা খেলতে পারবে না সেরকম নিয়ম নেই তাই মেয়েরা খুব উৎসাহ নিয়ে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলে। তবে এখনো সবচেয়ে প্রিয় খেলা সাত চাড়া —-তাকারণটা কী এখনো কেউ জানে না।
যেহেতু ঘুমানো নিয়ে তাড়া নেই তাই ক্লাশ শেষ হার পর যখন রেবেকা নিতকে বলল লাইব্রেরিতে একটা বই জমা দিহে যাওয়ার সময় তার সাথে যেতে নিতু রাজি হয়ে গেল। লাইব্রেরিটা কাছেই, সোজাসুজি মাঠের ভেতর দিয়ে গেলেই তাড়াতাড়ি হয় কিন্তু আজ রেবেকার কী হয়েছে কে জানে সে খেয়া বাধানো পথ ধরে রওনা দিল। শুধু যে খোয়া বাধানো পথ ধরে রওনা দিল তাই নয় রেবেকা হাঁটতে লাগল গদাই লস্করী চালে। নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, কী হল? তুই এরকম ঢিলে হয়ে গেলি কেন?
রেবেকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কী বললি?
নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, এখন সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর শুনতে হবে? হেঁটে হেঁটে শোনা যায় না?
যাবে না কেন? শোনা তো যায়ই। কিন্তু তবু রেবেকা নড়ে না, আরো ঢিলে হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।
তুই যেভাবে হাঁটছিস তাতে লাইব্রেরি যেতে লাগবে একমাস। রেবেকা খুব ধীরে ধীরে আবার হাঁটা শুরু করে বলল, লাগুক না। আমাদের কি কোনো তাড়াহুড়া আছে?
তাড়াহুড়া না থাকলেই তুই এরকম কচ্ছপের মতো হাঁটবি?
আচ্ছা বাবা অস্থা খরগোসের মতো হাঁটছি। বলে রেবেকা খরগোসের মতো দুইটা লাফ দিয়ে আবার দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসতে শুরু করে। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে খোয়া বাঁধানো পথের পাশে কী একটা দেখিয়ে বলে, দেখ, দেখ।
কী দেখব?
এই ফুল গাছটা। কী সুন্দর ফুল দেখেছিস?
তারা প্রতিদিন সকাল বেলা এই দিক দিয়ে স্কুলে যায় বিকাল বেলা এই দিক দিয়ে স্কুল থেকে ফেরৎ আসে এই ফুলের গাছগুলি সবসময়েই দেখছে–কিন্তু এখন হঠাৎ করে রেবেকার কাছে ফুলগুলি কেন সুন্দর মনে হচ্ছে নিতু বুঝতে পারল না। রেবেকা শুধু সুন্দর ফুল দেখেই মুগ্ধ হল না হঠাৎ করে বলল, আয় গুনে দেখি গাছে কয়টা ফুল আছে!
কী বললি?
গুনে দেখি একটা গাছে কয়টা ফুল। তুই এদিকে থেকে গোনা শুরু কর, আমি ওদিকে থেকে গুনি— বলে সত্যি সত্যি রেবেকা গোনা শুরু করল।
নিতু এবারে সত্যি সত্যি খেপে গেল, বলল, তোর ইচ্ছে হলে ফুল কেন, গাছের পাতা আর মাঠের ঘাস গুনতে থাক, আমি গেলাম।
নিতু সত্যি সত্যি হোস্টেলে রওনা দিতেই রেবেকা দৌড়ে এসে নিতুর হাত ধরে ফেলল, আয় আয় প্লীজ, আমার একা যেতে ইচ্ছে করছে না।
লাইব্রেরির দিকে রওনা দিয়েও রেবেকা শুধু ধানাই পানাই করে, লাইব্রেরিতে পৌছেও সে লাইব্রেরির দরজায় বসে থাকা বুয়ার সাথে গল্প জুড়ে দেয় শুধু তাই না তার ঘরে আসা আরেকজনকে তার আগে পাঠিয়ে দিয়ে ইচ্ছে করে খানিকটা সময় নষ্ট করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত সে বই জমা দিয়ে দেওয়ালে বড় ঘড়িটার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে হোস্টেলে ফেরার জন্যে সে খুব ব্যস্ত হয়ে গেল। নিতুকে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে হোস্টেলে এসে হাজির হল, ধুপ ধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে এবং নিতুকে প্রায় টেনে নিজেদের রুমের দিকে নিতে থাকে। প্রত্যেক দিন যখন নিতুরা ক্লাশ থেকে ফিরে আসে আজকাল সব রুমে মেয়েরা হৈ চৈ করে গল্প গুজব করতে থাকে কিন্তু আজকে কেমন যেন নীরব।