ওরা কিছু বলার আগেই শান্তা আপা কাছে যারা আছে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি আজ নতুন এসেছি বলে ওরা আমাকে হেল্প করছে! কী সুইট দেখেছেন?
খোরাসানী ম্যাডাম কিছু বলার চেষ্টা করে তোতলাতে শুরু করল তারপর থমথমে মুখে বলল, এই স্কুলে একটা নিয়ম কানুন আছে, ডিসিপ্লিন আছে—
শান্তা আপা মুখের হাসিটুকু একটুও না সরিয়ে ইংরেজিতে বললেন, আমি এই বিষয়গুলো আপনার সাথে পরে আলাপ করব। এদের সামনে নয়।
খোরাসানী ম্যাডামের কালো মুখ লাল হওয়ার চেষ্টা করে কেমন জানি বেগুনি হয়ে গেল, সেই অবস্থায় নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, এদের এখন ঘুমানোর কথা। ঘুম থেকে উঠে খেলাধুলা করার কথা।
সেটাই যদি নিয়ম হয় তাহলে সেটাই করবে। তবে আমি আজ নতুন এসেছি তো তাই এদের সাথে পরিচয় করার জন্যে আজ একটু রুটিন পাল্টানো হতে পারে–
খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল সে বুঝি এক্ষুনি শান্তা আপার উপর লাফিয়ে পড়বে, দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, এই বদমাইস হতচ্ছাড়া পাজী মেয়েগুলোকে–
শান্তা আপা আশ্চর্য রকম শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বললেন, এরা মোটেই বদমাইস হতচ্ছাড়া এবং পাজী মেয়ে নয়।
খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল কেউ বুঝি তার নাকের মাঝে দুই ইঞ্চি
তক্কা দিয়ে মেরে বসেছে। খানিকক্ষণ মুখ হা করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, পনের বছর থেকে এই স্কুলের নিয়ম কানুন চলে আসছে, তুমি সেদিনের মেয়ে—
শান্তা আপা চোখের পাতি না ফেলে বললেন, আমার নামা শান্তা চৌধুরী। কথাবার্তা বলার সময় আমাকে মিসেস চৌধুরী বলে সম্বোধন করবেন। আর আমাকে দেখে বোঝা না গেলেও আমার বয়স খুব কম নয়। আমাকে সহজেই আপনি করে সম্বোধন করা যায়।
খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল সে বুঝি এখন ফটাশ শব্দ করে ফেটে যাবে। দরজাটা খামচে ধরে হিংস্র চোখে শান্তা আপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি যেভাবে চালাই এই স্কুলে সেভাবে চলে।
শান্তা আপা ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, বেশ! তাহলে সেটাই হোক, আপনি যেভাবে চালাবেন সেভাবে এই স্কুল চলবে আর আমি যেভাবে চালাব সেভাবে এই হোস্টেল চলবে।
খোরাসানী ম্যাডাম হঠাৎ করে ঘুরে গেল তারপর দুম দুম শব্দ করে হেঁটে বের হয়ে গেল। শান্তা আপা তখন সাথে সাথে মেয়েদের দিকে ঘুরে যেন কিছুই হয় নি সেভাবে বললেন, এখন শেলফে বইগুলো তুলে ফেললেই আমাদের কাজ শেষ তাই না।
সবাই মিলে বইগুলো শেলফে তুলতে থাকে। তাদের মনে হতে থাকে যেন সত্যিই কিছু হয় নি। তাদেরকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু তারা বুঝে গেছে হালকা পাতলা ছোট-খাট কমবয়সী শান্তা আপা একই সাথে লোহার মতো শক্ত আবার মাখনের মতো নরম। শক্তটা হচ্ছে খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে আর নরমটা তাদের জন্যে। কী মজা!
নিতুর ইচ্ছে করল শান্তা আপাকে জড়িয়ে তার গালে একটা চুমু দিয়ে দেয় তার মাকে সে যেভাবে দিত।
শান্তা আপার ঘর গুছিয়ে তারা যখন বের হয়ে আসছে তখন বেশি উৎসাহ নিয়ে না দেখে হাঁটার জন্যে ঝুনু দেয়াল থেকে বের হয়ে আসা একটা ধাপের মতো জায়গায় পা বেঁধে আছাড় খেয়ে পড়ল। সাথে সাথে তার হাঁটুর কাছে খানিকটা ছাল উঠে গেল, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে ঝুনু ওঠার চেষ্টা করল এবং তখন অন্যেরা তাকে ধরে টেনে তুলল। রেবেকা ধমক দিয়ে বলল, তোর হয়েছেটা কী? দেখে হাঁটতে পারিস না?
ঝুনু ছিলে যাওয়া হাঁটুটা দেখে বলল, দেখেই তো হাঁটছিলাম।
শান্তা আপা এগিয়ে এসে নরম গলায় বললেন, আহা! ওকে বকছ কেন? ও তো ঠিকই হাঁটছিল, হঠাৎ করে ঘরের ভেতরে এরকম ভাবে একটা ধাপ করে রাখবে কে জানত?
নিতু তাকিয়ে দেকে সত্যিই তাই। ঘরের মাঝখানে হঠাৎ করে একটা ধাপের মতো জায়গা বের হয়ে এসেছে। এখানে এটা কেন করেছে কে জানে? সবাই যখন ঝুনুর ছিলে যাওয়া হাঁটু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে তখন নিতু ধাপটাকে পরীক্ষা করল। ঠোকা দিয়ে মনে হল এটা ফাপা, নিচু হয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, পাশে খানিকটা জায়গা থেকে সিমেন্টের আস্তরণ খসে পড়ে ভেতরে কাঠের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। শান্তা আপা যখন ঝুনুর ছিলে যাওয়া হাঁটু ধুয়ে সেখানে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে একটা তুলো বসিয়ে টেপ লাগিয়ে দিচ্ছিলেন তখন নিতু তার বল পয়েন্ট কলম দিয়ে ধাপের ভেতরের অংশটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল। সত্যিই এই ধাপটি ফাঁপা আর ভেতরে একটা বাক্সমতন কিছু একটা আাছে। ঝুনুকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সবাই নিতুর দিকে তাকাল, মিতুল বলল, তুই কী করছিস?
নিতু গম্ভীর হয়ে বলল, এই ধাপটা ফাঁপা। এর ভিতরে একটা গোপন বাক্স আছে।
গোপন বাক্স?
হ্যাঁ, এই দেখ, এদিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে।
নিতুর কথা শুনে সবাই আবার ধাপটার চারিদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শান্তা আপা চোখ বড় বড় করে বললেন, কী বললে, গোপন বাক্স?
জি আপা, এই দেখেন, নিতু ঠোকা দিয়ে বলল, এটা ফাঁপা।
শান্তা আপাও ধাপটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলছ, মনে হচ্ছে এই ধাপটার মাঝে বাক্স জাতীয় কিছু আছে।
সবাই এবারে চোখ বড় বড় করে শান্তা আপার দিকে তাকাল। মিতুল চোখ বড় বড় করে বলল, কী হতে পারে আপা? কোনো গুপ্তধন?
শান্তা আপা ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, একেবারে ঘরের ভেতরে গুপ্তধন?
নিতু মাথা নেড়ে বলল, কিংবা কাউকে মার্ডার করে ডেডবড়ি লুকিয়ে রেখেছে।
শান্তা আপা একটু শিউরে উঠলেন, কী বলছ তুমি?