মহিলাটি হাসি হাসি মুখে সবার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমাদের নূতন হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট। তোমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আমাকে তোমাদের বেশি পছন্দ হয় নাই, তাই সবাই এরকম মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছ! তাই না?
নিতু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, তাদের নূতন হোস্টেল সুপার গালাগাল না দিয়ে কথা বলছে! শুধু যে গালাগাল দিচ্ছে না তাই না এমন ভাবে কথা বলছে যেন তাদেরকে পছন্দ করে। মেয়েগুলির চোখে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর বিস্ময় এবং হঠাৎ করে একসাথে হাসি ফুটে উঠল। নূতন হোস্টেল সুপারের মুখও সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠে, এই তো সবাই হাসছে! কী সুন্দর লাগছে দেখতে, হাসি মুখ থেকে পৃথিবীতে সুন্দর কিছু আছে? নেই। হোস্টেল সুপারের কাজ খুব কঠিন। এত গুলি মেয়ের নিশ্চয়ই এতগুলি সমস্যা। কারো জ্বর উঠেছে, কারো মন খারাপ। কেউ বন্ধুর সাথে ঝগড়া করে আড়ি দিয়েছে, কারো বাসা থেকে চিঠি আসে নি, কারো পুতুলের মাথা আলগা হয়ে গেছে। কারো খেতে ইচ্ছে করছে না। কারো পড়তে ইচ্ছে করছে না। এত সমস্যা কী আর এক দিনে সমাধান করা যাবে? যাবে না। এই সব সমস্যা আস্তে আস্তে সমাধান করতে হবে। তোমরা আর অমিরা মিলে সমাধান করে ফেলব। সব অবিশ্যি সমাধান করা যাবে না, কিছু তো থেকেই যাবে। আর লাইফে যদি একটু আধটু সমস্যা না থাকে লাইফের কোনো মজাই থাকে না। তাই না?
সবগুলি মেয়ে গলা ফাটিয়ে চিঙ্কার করে বলল, জি, ম্যাডাম।
তাদের নূতন হোস্টেল সুপার মুখে আঁচল দিয়ে আবার খুক খুক করে হাসতে শুরু করলেন। তারপর হাসি থামিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্লীজ তোমরা আমাকে ম্যাডাম ডেকো না! ম্যাডাম শুনলেই আমার মনে হয় আমি বুঝি সুবেদার মেজর আর তোমরা সব আর্মী জওয়ান! হোস্টেল সুপার আবার মুখে আঁচল দিয়ে খুক খুক করে হাসতে লাগলেন।
তখন একটা ব্যাপার ঘটল যেটা বুতুরুনেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আগে কখনো ঘটে নি, নিতু নিজে থেকে হাত তুলে জিজ্ঞেস করে বসল, তাহলে আপনাকে কী ডাকব!
আমাকে আপা ডাকতে পার। আমার নাম শান্তা, তাই শান্তা আপা। ঠিক আছে?
সবগুলি মেয়ে এক সাথে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে শান্তা আপা!
শান্তা আপা আবার মুখে আঁচল দিয়ে খুক খুক করে হাসতে লাগলেন, কী জনে। কে জানে! হাসি অত্যন্ত সংক্রামক, এটি জলবসন্ত হাম আর হুপিং কফ থেকেও বেশি সংক্রামক তাই প্রথমে এক দুইজন তারপর দশ বারোজন এবং শেষে সবাই শান্তা আপার মতো খুক খুক করে হাসতে শুরু করল।
নিতু দেখল খোরাসানী ম্যাডাম বিস্ফোরিত চোখে একবার শান্তা আপা আরেকবার মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে কিছু একটা বলতে চাইছে, কয়েকবার মনে হয় চেষ্টাও করল কিন্তু বলতে পারল না।
এসেম্বলি শেষে সবাই সেদিন ক্লাশে গেল একটা অবিশ্বাস্য আনন্দ নিয়ে তাদের হোস্টেলে শেষ পর্যন্ত একজন সুপার এসেছে যে বাচ্চাদের পছন্দ করে। কী আশ্চর্য!
বিকাল বেলা ছুটির পর ক্লাশ থেকে সবাই দুদ্দাড় করে হোস্টেলে ফিরে এল, তাদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তাদের হোস্টেল সুপার হচ্ছে শান্তা আপা! তারা তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দেখতে চায় একটি সত্যি এটি আসলে স্বপ্ন নয়।
হোস্টেলে ফিরে এসে তারা আবিষ্কার করল এটি সত্যি। শান্তা আপা অদৃশ্য হয়ে যান নি, এখনো আছেন। শুধু আছেন না, ভালোমতোই আছেন, কোমরে শাড়ি প্যাঁচিয়ে তার ঘরটা পরিষ্কার করছেন। ঘরের বারান্দায় শান্তা আপার জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। মেয়েদেরকে ক্লাশ থেকে ফিরে আসতে দেখে উজ্জ্বল চোখে বললেন, কেমন হল তোমাদের ক্লাশ?
নিতুর চোখে পানি এসে গেল হঠাৎ, কতদিন হয়ে গেল কেউ তাদের সাথে এরকম নরম গলায় কথা বলে নি, তারা ভুলেই গিয়েছি যে তারা আসলে ফুটফুটে ছোট ছোট মেয়ে তাদের সাথে মিষ্টি করে কথা বলা যায় তখন তারাও মিষ্টি করে কথা বলে। তাদেরকে ভালবাসা যায় তখন তারাও ভালবাসে।
নিতু ঘাড় নেড়ে বলল, ভালো হয়েছে আপ।
ভেরি গুড়। যাও হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তোমাদের তো বাড়ন্ত বয়স, ভালো করে খেতে হবে সবার। বেশি করে ক্যালসিয়াম, হাড় গুলি যেন শক্ত হয়।
আহা! কী ভালো লাগছে শুনতে, কেউ একজন সত্যি সত্যি তাদের ভালো চাইছে। নিতুর মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো, তার মা যেরকম তার ভালো চাইতেন ঠিক সেরকম। নিতু স্কুলের ব্যাগটা নিচে রেখে বলল, আপা, আমি আপনার সাথে ঘর পরিষ্কার করি?
শান্তা আপা কিছু বলার আগে অন্য সব কয়জন মেয়ে বলে উঠল, আপা, আমরাও করি?
শান্তা আপা চোখ কপালে তুলে বললেন, সে কী! তোমরা ক্লাশ করে টায়ার্ড হয়ে এসেছো, এখন ঘর পরিস্কার করবে কি? আগে একটু রেস্ট নিয়ে খেয়ে দেয়ে এসো!
না আপা এখনই করি বলে সবাই মিলে শান্তা আপার ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করে দিল। শান্তা আপা হাসি মুখে ভালবাসার এই উৎপাতটুকু মেনে নিলেন, একা হলে হয়তো কাজটা গুছিয়ে করা যেতো, ঘরটা আরো ভালো করে সাজিয়ে নেয়া যেতো কিন্তু এরকম উৎসাহে বাধ সাধতে তার ইচ্ছে করল না।
ঘর যখন পুরোদমে সাজানো হচ্ছে তখন হঠাৎ করে দরজা অন্ধকার করে কী একটা দাঁড়াল, নিতু এবং অন্য মেয়েরা তাকিয়ে দেখল খোরাসানী ম্যাডাম। অন্য সময় হলে ভয়ে তাদের হার্ট ফেল করে যেতো কিন্তু আজ সবাই জানে তাদের শান্তা আপা ভয়ংকর খোরাসানী ম্যাডামের হাত থেকে রক্ষা করবেন, তাই কেউ ভয় পেল না। সোজাসুজি যেন খোরাসানী ম্যাডামের চোখে পড়তে না হয় সে জন্যে তারা শান্তা আপার পিছনে লুকিয়ে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম চোখ লাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, তোরা এখানে কী করছিস?