গভীর রাতে হঠাৎ বাইরে বিকট আর্তনাদ শুনে সবাই ধড়মড় করে জেগে উঠল। হোস্টেল সুপার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা আবার গিয়ে ঠিক একই জায়গায় হামলা করেছে।
আগের দিন ব্যাপারটি নিয়ে সবাই হেসে কুটি কুটি হয়েছে কিন্তু আজ আর হাসি পাচ্ছে না সবারই কেন যেন ভয় ভয় লাগছে। যদি হোস্টেল সুপারের কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে কী হবে? তানিয়া ভুরু কুচকে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আবার হোস্টেল সুপারের রুমে ছেড়ে দিয়ে এসেছিস?
নিতু মাথা নাড়ল, বলল, উহুঁ। নিজেই লাফিয়ে গেছে।
মিতুল শুকনো গলায় বলল, এখন কী হবে?
রেবেকা উদাস গলায় বলল, কী আর হবে। যা হবার তাই হবে।
পরদিন সকালে ওঠে সবাই খবর পেল, যা হবার তাই হয়েছে। হোস্টেল সুপার বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যে জায়গায় ভূতের ওৎপাত, বিশেষ করে ইঁদুরের ভূত সেখানে চাকরি করে জীবন খোয়াতে সে রাজি নয়।
মেয়েরা যদি আনন্দে গলা খুলে চিৎকার করার অনুমতি পেতো তাহলে তাদের সেই চিৎকার নিউ ইয়র্ক থেকে শোনা যেতো।
০৮. শান্তা আপা
সব আনন্দের পিছনে একটা করে দুঃখ থাকে। বুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্যে সেটা বেশি রকম সত্যি। তাদের কখনো কোনো আনন্দ থাকে না, যদি ভুল করে একটা আনন্দ হয়ে যায় তাহলে তার জন্যে মনে হয় দশটা দুঃখ এসে জমা হয়। কাজেই হোস্টেল সুপার চলে যাওয়ার জন্যে যে কিছু দুঃখ হাজির হবে তাতে অবাক হবার কী আছে। প্রথম দুঃখটি হল নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটিকে নিয়ে। একদিন ভোর বেলা সেটি বারান্দা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিচ্ছিরী একটা কাক এসে ছোঁ মেরে তাকে ধরে নিয়ে উড়ে গেল। নিতুর এতো মন খারাপ হল যে সেটি বলার নয়। সে অবিশ্যি কল্পনা করে তার ইঁদুরের বাচ্চাটা কাকের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে গিয়ে দূরে কোনো এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। একদিন তার সাথে দেখা করার জন্যে হেটে হেঁটে হোস্টেলে ফিরে আসবে ঠিক রূপকথার গল্পের মতো।
নিতু এবং তার বন্ধুদের দুই নম্বর দুঃখটি তাদের নূতন হোস্টেল সুপার নিয়ে। আগের হোস্টেল সুপার চলে যাওয়ায় নূতন একজনকে খোঁজা হচ্ছে এবং গত কয়েকদিন হল একজন মহিলাকে স্কুলে আসতে এবং যেতে দেখা যাচ্ছে। এই মহিলাটি নাকি কমবয়সী, ফর্সা এবং সুন্দরী। সেটাই হচ্ছে ভয়ের কারণ, কারণ দেখা গেছে একজন মানুষের চেহারা যত ভালো হয় সে তত অহংকারী হয়, আর মানুষ যত অহংকারী হয় তত বেশি নিষ্ঠুর হয়। একজন মানুষ যদি ভালো হয় নিতু-৫
তাকে এই স্কুলে নেয়া হয় না, এই স্কুলে যোগ দেওয়ার আগে একশ বার পরীক্ষা করে দেখা হয় মানুষটা কী রকম নিষ্ঠুর। হোস্টেলের মেয়েরা শুনেছে ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় কেউ যদি হেসে ফেলে সাথে সাথে তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ে কখনো প্রকাশ্যে কেউ হাসতে পারে না।
কাজেই যেদিন এসেম্বলিতে নূতন হোস্টেল সুপার এসে দাঁড়াল সবাই মনে মনে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। মহিলাটি হালকা পাতলা, কম বয়সী, ফর্সা এবং সুন্দরী, ঠিক যেরকম শুনেছিল, চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মহিলাটি কত নিষ্ঠুর, বিশেষ করে ঠোটের কোনায় চাপা হাসিটি দেখেই কেমন জানি বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠে।
এসেম্বলি শেষ হওয়ার পর খানিকক্ষণ ব্যায়াম হল—যখন হাত পা ছুড়ে লাফালাফি করতে হয়, তারপর খোরাসানী ম্যাডাম বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে একটু এগিয়ে এল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে খোরাসানী ম্যাডাম ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফেঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে হুংকার দিয়ে বলল, পাজী, বদমাইশ হতচ্ছাড়া বেজন্মা শয়তানের ঝাড়–
লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা ঠিক এরকমই একটা কিছু আশা করছিল কিন্তু তাদের নূতন হোস্টেল সুপার কেমন যেন চমকে ওঠে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকাল। খোরাসানী ম্যাডাম অবশ্যি ভ্রুক্ষেপ না করে কথা বলতে থাকে, তোদের পিটিয়ে ছাল চামড়া তুলে দেবার সময় হয়েছে। ভেবেছিলি হোস্টেলে কোনো সুপার নাই, মামদোবাজী আর ঘিড়িংগাবাজী করে সময় কাঁটাবি? তোদের সেই দিন শেষ। হোস্টেলে নূতন সুপার এসেছে, সে যেন তোদের রগড়া দিয়ে সিধে করে রাখে সেটা আমি নিজে ব্যবস্থা করব। মনে থাকে যেন বুতুরুন্নেসা স্কুল কোনো রং তামাশার জায়গা না। এখানে বানর হয়ে ঢুকৰি মানুষ হয়ে বের হবি। খোরাসানী ম্যাডাম সেনাপতির মতো সবার দিকে তাকিয়ে একটা হুংকার দিয়ে বলল, মনে থাকবে তো?
সবগুলি মেয়ে চিৎকার করে বলল, থাকবে ম্যাডাম।
খোরাসানী ম্যাডাম রক্তচক্ষু করে হুংকার দিল, জোরে।
সবাই দম ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, থাকবে ম্যাডাম।
লাইনে দাঁড়ানো শ খানেক মেয়ে অবাক হয়ে দেখল তাদের নূতন হোস্টেল সুপার হঠাৎ শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে খুক খুক করে হাসতে শুরু করেছে। এই স্কুলে কেউ হাসছে তাও একজন শিক্ষিকা, এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে—এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার, কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সবাই ভালো করে তাকাল, চোখের ভুল নয় সত্যিই নূতন হোস্টেল সুপার হাসছে। অন্য শিক্ষিকারা কেমন যেন ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে আর তাই দেখে খোরাসানী ম্যাডামের চোখ মুখ একেবারে থমথমে হয়ে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে নূতন হোস্টেল সুপারকে নিচু গলায় কিছু একটা বলল, তখন হোস্টেল সুপার হাসি থামিয়ে এক পা সামনে এগিয়ে আসে। মনে হয় কিছু একটা বলবে, গালাগাল দিয়ে শুরু করবে নিশ্চয়ই, কী গালাগাল দেবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।