যে ছয়টি মেয়ে এই নেংটি ইঁদুরের বাচ্চার ইতিহাস জানে তারা ছাড়া অন্য সবাই হঠাৎ করে আতংক একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল। হোস্টেল সুপার ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমি যখন হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করেছি তখন শরীরের কাপড়ের ভিতর ঢুকে গেল।
মেয়েগুলি আবার একটা শব্দ করল, আনন্দে না ভয়ে এবার সেটা ঠিক ভালো করে বোঝা গেল না। জমিলার মা অবিশ্যি হোস্টেল সুপারের কথা বিশ্বাস করল না, মাথা নেড়ে বলল, জীনের আছর।
মিতুল অবাক হবার ভান করে বলল, জীনের আছর?
হ্যাঁ।
কেন? জীন কেন হবে?
ইন্দুর কখনো মানুষের কাছে আসে না। ইন্দুর মানুষকে ভয় পায়। মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকে।
সত্যি?
হ্যাঁ। ইন্দুর মানুষের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারে না। তাদের নিশ্বাসের থেকে দূরে থাকে। এইটা ইন্দুর না। অন্য কিছু।
হোস্টেল সুপার ফ্যাকাসে মুখে বলল, তাহলে এইটা কী?
জীন ভুতের আছর হলে এরকম হয়। আমার ফুপাতো বোনের হয়েছিল।
কিন্তু—কিন্তু–হোস্টেল সুপার তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমার স্পষ্ট মনে হল ইঁদুর।
নিতু হঠাৎ বলে ফেলল, হয়তো ইঁদুরের ভূত।
হোস্টেল সুপার ঢোক গিলে বলল, কী বললি?
বলেছি, ইয়ে মানে ইঁদুরের ভূত। মানে ইঁদুর মরে যে ভূত হয়।
ই-ই-ইঁদুরের ভূত?
হ। মনে নাই সোদন যে ইঁদুর গুলি মেরেছিলেন? মানে ইয়ে, হয়তো তাদের ভূত এসেছে। আপনি মেরেছিলেন তাই আপনার ওপরে রাগ বেশি। হতে পারে না?
এখানে ভূত বিষয়ক অভিজ্ঞ মাত্র একজনই, জমিলার মা, সবাই তার দিকে তাকাল, হতে পারে?
জমিলার মা মাথা চুলকে বলল, বলা মুশকিল। তবে—
নিতু বলল, মানুষ মরে যদি মানুষের ভূত হয় তাহলে ইঁদুর মরে ইঁদুরের ভূত কেন হতে পারে না?
হোস্টেল সুপার এতক্ষণ পর হঠাৎ খেয়াল করল যে তার দুর্দশা নিয়ে মেয়েরা কথাবার্তা বলছে। ব্যাপারটি ভালো নয়। সে তার শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে মুখ গম্ভীর করে ধমকে দিয়ে বলল, যা সবাই ঘুমাতে যা। তোরা কেন বিছানা থেকে উঠে এসেছিল।
ধমক খেয়ে সবাই নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল। নিতু এবং তার পাঁচ রুমমেট দরজা বন্ধ করে হেসে কুটি কুটি হয়ে গেল। যখন শুনতে পেল নিতু নিজে গিয়ে ইঁদুরের বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে তখন অন্যেরা বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল।
নিতু হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, ইঁদুরের বাচ্চাটা এখনো ফিরে আসে। নি। তার মানে কী জানিস?
কী?
আজ রাতে আবার এটাক হতে পারে!
ব্যাপারটা চিন্তা করে আবার সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে।
বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পর আবার যখন তাদের চোখে প্রায় ঘুম লেগে এসেছে তখন দ্বিতীয়বার হোস্টেল সুপার বিকট স্বরে চিৎকার করে লাফঝাপ দিতে শুরু করল। অন্য অনেকে দ্বিতীয়বার মজা দেখতে গেলেও এই ছয়জন ঝুঁকি নিল না, হোস্টেল সুপারের নর্তন কুর্দন দেখতে দেখতে হঠাৎ করে হেসে ফেললে বিপদ হয়ে যাবে। তা ছাড়া হাসি জলবসন্ত এবং হাম থেকেও বেশি সংক্রামক, একজন হেসে ফেললে অন্য সবাই হাসতে শুরু করব। এরকম একটা ব্যাপারে হাসি আটকে রাখা অসম্ভব ব্যাপার।
মিনিট দশেক তারা হোস্টেল সুপারের চিৎকার লাফঝাপ এবং হৈ চৈ শুনতে পেল। তারপর শব্দ কমে এল, যারা মজা দেখতে গিয়েছিল তাদের কাছে শুনতে পেল, হোস্টেল সুপার নাকি আর ঘুমুতে যাচ্ছে না। লাল রংয়ের একটা দোয়াদরূদের বই বুকে চেপে ধরে বিছানায় পা তুলে বসে আছে। নিতু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, ঘরের বাতি জ্বালানো থাকলে হঠাৎ করে যদি তার ইঁদুরের বাচ্চাকে দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তা ছাড়া ইঁদুরের বাচ্চাটা জানে না মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকতে হয়।
নিতুর ভয় অবশ্য কিছুক্ষণেই কেটে গেল, হঠাৎ করে মনে হল কিছু একটা তার হাত বেয়ে তির তির করে উঠে আসছে। সে লাফ দিয়ে ওঠে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে ধরে ফিস ফিস করে বলল, পাজী ছেলে! এখন আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিস? এক রাতের জন্যে অনেক এডভেঞ্চার হয়েছে এখন ঘুমুতে দে আমাদের।
নিতু চকলেটের টিনে ইর্দুরের বাচ্চাটাকে আটকে রাখল, ভোর হওয়ার আগে আর তাকে ছাড়া হবে না।
পরদিন হোস্টেল সুপারকে দেখে সবাই শিউরে উঠল, একরাতে তার বয়স মনে হয় পঞ্চাশ বছর বেড়ে গেছে। চুল ময়লা পাটের মতো উশখু খুশকো চোখ গভীর গর্তে ঢুকে গেছে। মুখ তোবড়ানো, শুকনো চামড়া ঝুলে পড়েছে। মনে হয় সোজা হয়ে হাঁটতেও পারছে না, কেমন যেন কুঁজো হয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে ঘটছে। গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়ে সেখান থেকে ফ্যাসফ্যাসে একটা শব্দ বের হচ্ছে একটা ছোট ইঁদুরের বাচ্চা একজন বড় মানুষকে এভাবে কাবু করতে পারে নিজের চোখে না দেখলে নিতু কখনো বিশ্বাস করত না।
গভীর রাতে আবার নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল, সারাদিন এডভেঞ্চার করে ইঁদুরের বাচ্চা ফিরে এলে আবার তাকে চকলেটের টিনে আটকে রাখা হয়েছে। নিতু শুনতে পেল সে কুট কুট করে শব্দ করছে, এখান থেকে বের হতে চায়।
একবার হোস্টেল সুপারের রুমে ছেড়ে দেবার পর কী অবস্থা হয়েছে সে দেখেছে, আবার ছেড়ে দিলে কী হবে কে জানে! নিতু ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এলো না, ইঁদুরের বাচ্চার এই শোনা যায় না এরকম কুট কুট শব্দকে যে এত বেশি শব্দ মনে হবে সেটা কে জানত। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে নিতু নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাকে টিন থেকে বের করে আনল, ইঁদুরটা এর মাঝেই একটু লায়েক হয়ে গেছে। বের করা মাত্রই তিড়িং বিড়িং করে কয়েকটা লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, কোথায় গিয়েছে কে জানে। আজ রাতে না জানি কার সর্বনাশ করবে!