বাবা মিন মিন করে বললেন, না, মানে ইয়ে আমার মেয়েকে দিয়ে যেতে এসেছি।
কোন মেয়ে?
ওর নাম হচ্ছে মানে—
মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, নাম দিয়ে কী হবে? এখানে সব নম্বর। কত নম্বর মেয়ে?
বাবা তাড়াতাড়ি নিতুর কাগজপত্র বের করে নম্বর দেখে বললেন, সাতশ বিয়াল্লিশ।
ইলেকট্রিক শক খাওয়া মানুষটা তার হাতের রেজিস্টার খাতাতে কিছু একটা দেখে গেট খুলে দিয়ে বলল, ভিতরে।
বাবা নিতুকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন তখন লোকটা আবার ধমক দিয়ে বলল, আপনি ঢুকছেন কেন? আপনি কি এই স্কুলে পড়বেন?
না—মানে ভিতরে দিয়ে আসি।
এর ভিতরে বাইরের মানুষের টোকা নিষেধ।
বাবা নিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে জোর করে একটা খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে বললেন, বলেছিলাম না খুব ভালো স্কুল? দেখেছিস শৃঙ্খলার দিকে কী রকম নজর?
নিতু মাথা নাড়ল, বলল, একটু বেশি নজর। মনে হয় এখানে চোর
ডাকাতের মেয়েরা পড়তে আসে।
নিতুর কথা শুনে বাবা চোখ পাকিয়ে তাকালেন তারপর শুকনো গলায় বললেন, তুই তাহলে ভিতরে যা। ভালো হয়ে থাকিস।।
খাড়া খাড়া চুল দাড়িওয়ালা ডাকাতের মতো মানুষটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, সেটা আর বলে দিতে হবে না। এই খানে ভালো হয়ে না থাকলে– মানুষটা কথা শেষ না করে ডান হাত দিয়ে ম্যাচ করে গলায় পোচ দেবার মতো একটা ভঙ্গি করল। দেখে হঠাৎ নিতুর শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বাবা নিতুর হাতে কাগজগুলি দিয়ে বললেন, যা, দেরি করিস না।
নিতু এক হাতে তার টেডি রিয়ার ভোটকা মিয়াকে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ভারী স্যুটকেসটা টেনে টেনে ভিতরে ঢুকল। গেটটা পার হওয়া মাত্র পিছনে ঘর ঘর করে সেটা বন্ধ হয়ে গেল, নিতুর হঠাৎ মনে হয় সে বুঝি সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেছে।
গেট থেকে খোয়া বাধানো রাস্তা ভিতরে চলে গেছে। রাস্তার দুই পাশে নানা ধরণের গাছ গাছালি, একটু ভিতরে পোড়াবাড়ির মতো একটা মন খারাপ করা দালান। তার পিছনে টিনের ছাদের ছোট ছোট বাসা। স্কুল হলে যেরকম ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়ের হৈ চৈ কলরব শোনা যাবার কথা এখানে সেরকম কিছু নেই। চারিদিকে কেমন জানি সুমসাম নীরবতা। এটি যেন স্কুল নয়—এটি যেন একটি কবরস্থান।
কী করবে বুঝতে না পেরে নিতু কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইল তারপর ভারী সুটকেসটা টানতে টানতে মন খারাপ করা দালানটার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। যেতে যেতে সে ফিস ফিস করে বুকে আঁকড়ে থাকা টেডি রিয়ারটার সাথে কথা বলতে শুরু করে, বুঝলে ভোটকা মিয়া, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ঐ দালানটা দেখে ভয় ভয় লাগলেও দেখবে সেখানে সব ভালো ভালো মানুষেরা থাকে। আমারা হাজির হতেই দেখবে সবাই ছুটে আসবে!
দালানটার কাছে পৌঁছানোর পর কেউ অবিশ্যি ছুটে এল না। ভারী স্যুটকেসটা অনেক কষ্ট করেও সিঁড়ি দিয়ে তুলতে না পেরে সে হাল ছেড়ে দিয়ে স্যুটকেসটার উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। ভোটকা মিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বুঝলে ভোটকা মিয়া, আমরা এখানেই বসে থাকি, যার দরকার সেই আমাদের খুঁজে বের করবে।
নিতুর সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হল, কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ মনে হল তার সামনে একটি পাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে। নিতু ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকাল, মনে হল প্রায় আকাশের কাছাকাছি মাথা পৌছে গেছে এরকম একজন তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। মানুষটি নিশ্চয়ই একজন মহিলা কারণ একটা শাড়ি পরে আছে, কিন্তু তার চেহারা দেখে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। মাথার চুল শক্ত করে টেনে পিছনে ঝুঁটি করে বেঁধে রাখা, সামনে থেকে মাথায় কোনো চুল আছে কী নেই সেটা বোঝা যায় না। গায়ের রং শ্যামলা, শরীর পাথরের মতো শক্ত। শাড়ি পরলে মেয়েদের চেহারার একটা কমনীয়তা চলে আসে কিন্তু এই মহিলার বেলায় সেটা সত্যি নয়। মেয়েরা যদি আমীর হাবিলদার হতো তাহলে নিশ্চয়ই এই ভাবে শাড়ি পরতো। মহিলার চোখ লাল এবং নিতুকে দেখে সেটা
আরো লাল হয়ে উঠল। সেই আকাশের কাছাকাছি মাথা থেকে হঠাৎ যেন বিজলী চমকে উঠল, বিশাল একটা মুখ হঠাৎ একটা বড় ট্রাঙ্কের ঢাকনার মতো খুলে যায়, ভিতর থেকে কালো মাড়ি এবং ধারালো দাঁত বের হয়ে আসে এবং নিতু একটা গর্জন শুনতে পায়, এটেনশান।
নিতু কী করবে বুঝতে পারল না, রাস্তা ঘাটে পুলিশ মিলিটারি যখন মার্চ করে তখন এটেনশন বললে তারা পা ঠুকে সোজা হয় দাঁড়িয়ে যায়। তাকেও কি সে রকম কিছু করতে হবে? কী করবে ঠিক করতে নিশ্চয়ই তার দেরি হয়ে গিয়েছিল কারণ কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ মনে হল একটা বাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং তার ঝুঁটি ধরে প্রায় শূন্যে তুলে তাকে দাড় করিয়ে দিয়েছে। নিতু পিট পিট করে তাকাল এবং দেখতে পেল বিশাল কেঁদো বাঘের মাখার মতো একটা মুখ তার দিকে নেমে আসছে, মাথাটি নামতে নামতে একেবারে তার মুখের কাছে নেমে এল, এত কাছে নেমে যে নিতু তার চোখের লাল শিরা, নাকের ভিতরে লেমি এবং দাঁতের ফাকে লেগে থাকা মাংসের টুকরাগুলি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেল। শুধু তাই নয় তার নাকে ভক করে একটা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়—কেউ যদি বাঘের মুখ খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেয় তাহলে সে নিশ্চয়ই এরকম একটা গন্ধ পাবে। কেঁদো বাঘের মুখের ভিতর থেকে আরেকটা গর্জন বের হয়ে আসে, তু-ই-কে-রে?
নিতু নাম বলতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেল, মনে পড়ল এখানে কারো নাম নেই, সবার একটি করে নম্বর। সে ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলল, আমি সাতশ বিয়াল্লিশ।