- বইয়ের নামঃ নিতু আর তার বন্ধুরা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়
নিতুর বয়স যখন দশ বছর তিন মাস এগার দিন তখন নিতুর মা মারা গেলেন। নিতুর বাবা তখন, ও নিতুর মা গো, তুমি আমাকে কোথায় ফেলে চলে গেলে গো, আমার কী হবে গো এই সব বলে মাথা চাপড়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন টানা সাতদিন। আট দিনের দিন নিতুর বাবা কান্না থামিয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করলেন, নিতু রে, তোর নিশ্চয়ই একা একা খারাপ লাগছে?
নিতু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।
বাবা উদাস উদাস চেহারা করে বললেন, তোর জন্য একটা নূতন মা খুঁজে আনতে হবে।
নিতু চোখ কপালে তুলে হা হা করে বলল, না, না, বাবা লাগবে না! একেবারেই লাগবে না।
নিতুর বাবা কথা শুনলেন না এক মাসের মাঝে বিয়ে করে একজন নূতন মা নিয়ে এলেন। নিতুর আসল মা ছিলেন হালকা পাতলা এই মা হলেন মোটাসোটা। আগের মা ছিলেন হাসিখুশি আর, এই মা হলেন বদরাগী। সত্যিকারের মা ছিলেন সাদাসিধে ভালোমানুষ আর এই মা হলেন কুটনী বুড়ি। বিয়ের পর অনেক কষ্ট করে এক দুই সপ্তাহ মুখে হাসি ধরে রাখলেন তারপর তার আসল রূপ বের হয়ে এল। নূতন মায়ের যন্ত্রণায় নিতুর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে
নিতুর বয়স যখন দশ বছর পাঁচ মাস সতের দিন তখন একদিন তার বাবা তাকে ডেকে বললেন, আজকাল স্কুলে কোনো লেখা পড়া হয় না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পড়াশোনা ছিল খুব হাই স্ট্যান্ডার্ড।
নিতুর বাবা আসলে কী বলতে চাইছেন বোঝার জন্যে নিতু চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। নিতুর বাবা বললেন, আমরা যখন তোর মতো ছোট ছিলাম তখন বাবোর নাম বলতে পারতাম, কান চুলকানোর ইংরেজি বলতে পারতাম।
আমরাও পারি।
পারিস নাকি? শুনে মনে হল বাবার একটু মন খারাপ হল। মুখ গম্ভীর করে বললেন, যাই হোক, পড়াশোনার পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা কমপ্লিট প্যাকেজ।
প্যাকেজ?
হ্যাঁ। বুঝলি—অঙ্ক করার সাথে সাথে ঘুমানো শিখতে হয়, ইংরেজি গ্রামারের সাথে ভাত খাওয়া।
বাবা কী বলতে চাইছেন বুঝতে না পেরে নিতু এবারে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। বাবা নিতুর চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে বললেন, তাই ঠিক করেছি তোকে একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে দিয়ে দেব।
কী স্কুল?
রেসিডেন্সিয়াল স্কুল। মানে যেখানে তুই থাকবি এবং পড়াশোনা করবি। একই সাথে স্কুল আর হোস্টেল।
নিতু অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, তার নূতন মা শেষ পর্যন্ত বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন! বাৰা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, দেখবি কী সুন্দর স্কুল। ফিটফাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যে রকম ডিসিপ্লিন সে রকম পড়াশোনা।
নিতু কোনো কথা না বলে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, দেখবি তোর কত ভালো লাগবে। নিজে নিজে স্বাধীনভাবে থাকবি।
নিতু এবারে বাবার দিকে তাকিয়ে একরকম জোর করে দাঁত বের করে হাসল। বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, কী হল? এরকম করে হাসছিস কেন?
আনন্দে।
আনন্দে?
হ্যাঁ।
কীসের আনন্দে?
আমার বয়স মাত্র দশ সেই আনন্দে। যদি আমি আরেকটু বড় হতাম তাহলে তোমরা আমাকে জোর করে ধরে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে। কী বাঁচা বেঁচে গেছি সেই আনন্দে।
বাবা অবাক হয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কিছু বললেন না। নিতু ঠিকই আন্দাজ করেছে, তার নূতন মা সত্যি সত্যি আফসোস করেছে কেন সে আরো কয়েক বছর বড় হল না তাহলেই তো বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করে দেয়া যেত।
সপ্তাহখানেক পরে নিতু একটা স্যুটকেসে তার জামা কাপড়, তার প্রিয় গল্পের বই আর তার ছেলেবেলার কয়েকটা পুতুল ভরে নিল। স্যুটকেসের তলায় রাখল তার মায়ের একটা ফ্রেম করা ছবি। তার ঘুমানোর সাথী টেডি বিয়ার ভোটকা মিয়াকে হাতে নিয়ে নূতন স্কুলে রওনা দিল। বাবা তাকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ট্রেনে, ট্রেন থেকে নেমে বাস। বাস থেকে নেমে ফেরি। ফেরি থেকে স্কুটার। স্কুটার এসে থামল উঁচু দেওয়াল ঘেরা একটা পুরানো বাড়িতে, দেখে দিনের বেলাতেই কেমন জানি গা ছম ছম করে। উঁচু দেওয়ালের ওপর কাঁটাতার দেওয়া দেখে মনে হয় বুঝি জেলখানা। সামনে একটা বড় লোহার গেট, গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় ভিতরে বড় বড় গাছ। গেটের উপরে একটা সাইন বোর্ড, সাইনবোর্ডে লেখা :
বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়
স্থাপিত ১৯৬৭ ইং
বালিকাদের আবাসিক শিক্ষাঙ্গন
শিক্ষা এবং শৃঙ্খলার সমন্বয়।
নিতু ভয়ে ভয়ে দেখল শৃঙ্খলা কথাটি লাল রং দিয়ে লেখা, দেখেই কেমন জানি গা শির শির করে উঠে।
গেটটা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখা, বাবা ভয়ে ভয়ে কয়েকবার শব্দ করতেই পাশের ছোট ঘর থেকে দরজা খুলে একটা মাথা উঁকি দিল। মানুষটা সম্ভবত দারোয়ান, সারা মুখ চুল দাড়িতে টাকা। কবি রবীন্দ্রনাথেরও বড় বড় চুল দাড়ি কিন্তু তাকে দেখে কেমন জানি শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব হয়, এই মানুষটার বেলায় একেবারে উল্টো দেখেই কেমন জানি ডাকাত ডাকাত মনে হয়। লোকটার চুল দাড়ি খাড়া হয়ে আছে দেখে মনে হয় মাথার ওপরে বাজ পড়ে ইলেকট্রিক শক খেয়ে সব চুল দাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। মানুষটা লাল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বাজখাই গলায় হুংকার দিল, কী চাই?