আমিও ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, কি ঝামেলা?
মনে আছ সেই বইটা?
কোন্ বইটা?
নীল নয়নার অভিসার। তোকে দেখিয়েছিলাম?
আমার মনে পড়ল, বাবা বাসায় ছিলেন বলে বইটা পড়তে নিতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে সেই বইটার?
খুঁজে পাচ্ছি না।
খুঁজে পাচ্ছিস না?
না।
সর্বনাশ।
হ্যাঁ। কাল ফেরৎ দিতে হবে। সলীল শুকনো মুখে বলল, না হয় সঞ্জয়দা আমাকে ধরে একেবারে কঁচা খেয়ে ফেলবে। লাইব্রেরি থেকে এনেছিল।
কোথায় হারিয়েছিস?
জানি না। সব জায়গায় খুঁজে ফেলেছি। কোথাও নাই। আমার কি মনে হয় জানিস?
কি?
জারুল চৌধুরীর বাসায় ফেলে এসেছি।
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম, জারুল চৌধুরী?
হ্যাঁ। সলীল মুখ কাচুমাচু করে আমার দিকে তাকাল, কিছু বলল না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন তোর জারুল চৌধুরীর বাসায় যেতে হবে?
সলীল মাথা নাড়ল। তাপর মুখ আরো কাচুমাচু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তুই চাস আমি তোর সাথে যাই?
সলীল জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
কখন যেতে চাস?
সময় নাই। টিফিন ছুটির সময় যেতে হবে।
ক্লাস ফাঁকি দিয়ে?
সলীল আবার এমনভাবে মুখ কাচুমাচু করে তাকাল যে আমি আর না করতে পারলাম না।
.
টিফিন ছুটির সময় আমি আর সলীল আলাদা আলাদাভাবে ক্লাস থেকে সাবধানে বের হয়ে এলাম। ক্লাসে এত ছেলে, আমাদের কেউ যদি খোঁজ না করে, ধরা পড়ার কোন ভয় নেই। সাবাইকে জানিয়ে শুনিয়ে হৈ চৈ করে কখনো ক্লাস থেকে পালানো যায় না, কিন্তু গোপনে, কাউকে না জানিয়ে সটকে পড়া এমন কিছু কঠিন ব্যাপার না। তাছাড়া আমি তো আর স্কুল ফাঁকি দেওয়ার জন্যে যাচ্ছি না, যাচ্ছি বন্ধুকে বিপদে সাহায্য করার জন্যে। একজন পাগল মানুষের বাসায় তো আর সলীলকে একা যেতে দিতে পারি না। হঠাৎ যদি রাম দা হাতে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জারুল চৌধুরী? কেটে যদি পুঁতে ফেলে? দুইজন থাকলে তবু কিছু একটা করা যাবে, একা থাকলে কোন উপায়ই নেই।
হেঁটে হেঁটে যাবার সময় যখন সুতরাপুরের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি তখন রাস্তার পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় দোতলা সাদা একটা দালান চোখে পড়ল। গেটের উপর একটা বড় বোর্ডে লেখা, “গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক”। এটাই নিশ্চয়ই জয়নালের সেই ক্লিনিক, যেখানে গরিব বাচ্চাদের নানারকম পরীক্ষা করে টাকাপয়সা দেয়। আমি যেতে যেতে ক্লিনিকটাকে ভাল করে দেখলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চকচকে দোতলা একটা দালান। জায়গাটা অবিশ্যি একটু বেশি নিরিবিলি। দেয়াল দিয়ে ঘেরা বড় একটা জায়গা, ভিতরে নানা রকম গাছপালা। ক্লিনিকটা দেখে মনে হয় নির্জন, ভিতরে কোন রোগী আছে বলে মনে হয় না। কোন রকম রোগী না পেলে এই ক্লিনিক কেমন করে চলবে কে জানে!
সলীল আমাকে জিজ্ঞেস করল, কি দেখছিস?
না কিছু না –বলেও আমি ঘাড় ঘুরিয়ে গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকটাকে দেখতে থাকি। দোতলায় মনে হল একটা বাচ্চা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে, সাথে পরিষ্কার কাপড় পরা একজন মানুষ। কে জানে, এই মানুষটাই হয়তো ডাক্তার নাওয়াজ খান। জয়নালের ভাষায় ফিরিশতার কিসিমের মানুষ।
সলীল আবার জিজ্ঞেস করল, কি দেখছিস?
নাহ কিছু না। বলেও আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছু না মানে? সলীল একটু রেগে বলল, সেই তখন থেকে ঘাড় বাঁকা করে দেখছিস, আর বলছিস কিছু না।
না, মানে, বলা নিষেধ।
কি বলা নিষেধ?
একটা জিনিস যদি বলা নিষেধ হয় সেটা কেমন করে বলি? যদি বলা হয় সেটা কি নিষেধ মানা হল?
সলীল কি রকম জানি কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, আমাকে বললে ক্ষতি কি? আমি কি কাউকে বলে দেব? কখনো দিই?
আমার নিজেরও জয়নালের কথাটা বলার জন্যে মুখটা সুড়সুড় করছিল, তাই শেষ পর্যন্ত সলীলকে বলে দেয়াই ঠিক করলাম। বললাম, ঠিক আছে, তোকে বলতে পারি। তুই কাউকে বলবি না তো?
না।
খোদার কসম?
খোদার কসম। ভগবানের কীরা।
আমি তখন সলীলকে জয়নালের কথাটা খুলে বললাম। কেমন করে সে গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকে যায় এবং কেমন করে ডাক্তার নাওয়াজ খান তাকে টিপে টুপে। পরীক্ষা করে টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। সব শুনে সলীল একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি? সত্যি?
সত্যি। আমি নিজে জয়নালের মানি অর্ডার ফরম ফিলআপ করে দিয়েছি। আমি জানি। তোর কি মনে হয় সলীল, নাওয়াজ খান মানুষটার কি কোন বদ মতলব আছে?
বদ মতলব? সলীল চোখ কপালে তুলে বলল, বদ মতলব কেন থাকবে? একজন দেবতার মত মানুষ, গরীব বাচ্চাদের সাহায্য করছে, আর তুই বলছিস বদ মতলব?
খামাখা কি আর কেউ কাউকে সাহায্য করে? খোঁজ নিয়ে দেখ, নিশ্চয়ই কোন না কোন বদ মতলব —
সলীল রেগে গিয়ে বলল, তোর মনটাই প্যাচালো। কোন ভাল জিনিস দেখিস না। পৃথিবীতে যত জন খারাপ মানুষ তার থেকে অনেক বেশি ভাল মানুষ, সেটা জানিস?
আমি মাথা নাড়লাম, জানি না।
তাহলে জেনে রাখ। গাধা কোথাকার।
আমি আর তর্ক করে কথা বাড়ালাম না। সত্যিই যদি পৃথিবীতে ভাল মানুষ বেশি থাকে, ব্যাপারটা খারাপ হয় না। কিন্তু আমার সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে।
সলীল হেঁটে যেতে যেতে বলল, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।
কি আইডিয়া?
মনে আছে পারভেজ স্যার যে একাট রচনা লিখতে দিয়েছেন?
আমি মাথা নাড়লাম, মনে আছে। পারভেজ স্যার একজন কমবয়সী স্যার, নতুন এসেছেন, সব ব্যাপারে খুব উৎসাহ। আমাদের নানারকম বিচিত্র জিনিস দিয়ে রচনা লিখতে দেন। গত সপ্তাহে রচনার বিষয়বস্তু ছিল ”আমি যদি পোকা হতাম”, এর আগের সপ্তাহে ছিল ”নিউটনের যদি একটা কম্পিউটার থাকত”! খুব মজার বিষয়বস্তু, লিখতে গিয়ে আমাদের এমন সব ব্যাপার চিন্তা করতে হয় যেটা আগে কোনদিন চিন্তা করিনি। সেই তুলনায় এই সপ্তাহের বিষয়টি অনেক সোজা –”আমার দেখা একজন খাঁটি মানুষ।” আমি কাকে নিয়ে লিখব সেটা এখনো ঠিক করিনি। সলীল মনে হয় ঠিক করে ফেলেছে। জিজ্ঞেস করলাম, কাকে নিয়ে লিখবি।