ঠিক আছে। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমাকে যদি বলতে না চাস বলিস না। আমি উকিল সাহেবকে জিজ্ঞেস করব।
সাথে সাথে জয়নালের মুখ একেবারে কাদো কাঁদো হয়ে যায়। একেবারে আমার হাত ধরে ফেলে বলল, আল্লাহর কসম লাগে আপনার মনির ভাই, উকিল সাহেবরে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। যদি করেন আমার সব টাকা নিয়ে যাবে। গরিব মানুষের টাকা। এত কষ্টের টাকা
আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, তাহলে বল কোথায় পেয়েছিস।
জয়নাল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি কাউকে বলবেন না?
বলব না?
খোদার কসম?
খোদার কসম।
জয়নাল মাটি থেকে একটা কাঠি তুলে খুব মনোযোগ দিয়ে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, আমি গরু নিয়ে নদীর পাড়ে যাই মাঝে মাঝে। নদীর ঘাটে মিনতির কাজ করে কিছু পোলাপান। একজনের নাম রশীদ।
জয়নাল পিচিক করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুতু ফেলে বলল, রশীদ শালার সৎ মা। বাপ রিকশা চালায়। ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। হঠাৎ দেখি নবাবের বাচ্চা একটা নতুন শার্ট আর লুঙ্গি পরে এসেছে। পকেটে চিরুণী। নদীর ঘাটে চায়ের দোকানে বসে মালাই দিয়ে চা খাচ্ছে! আমি জিজ্ঞেস করলাম, টাকা কই পেলি? চুরি করেছিস? রশীদ কিরা কেটে বলল চুরি করে নাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে? প্রথমে বলতে চায় না, শালারে অনেক তেল মালিশ করলাম। তখন বলল।
কি বলল?
বলল, সুতরাপুরের কাছে গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক আছে, সেখানে বড় ডাক্তারের নাম নাওয়াজ খান। নাওয়াজ খান দিয়েছেন।
নাওয়াজ খান টাকা দিয়েছেন?
জে।
কেন?
জয়নাল ঠোঁট উল্টে বলল, জানি না। নাওয়াজ খান সাহেব এমনিতে ফিরিশতার মত মানুষ। রোশনাই চেহারা। গরিব পোলাপানদের খুব আদর যত্ন করেন। কেউ যদি খান সাহেবের কাছে যায় খান সাহেব সাহায্য করেন। খালি কিরা কেটে বলতে হয়। কাউরে বলা যাবে না। সেই জন্যে আপনারে বলতে চাই নাই।
কাউকে বলা যাবে না?
না।
কি বলা যাবে না?
এই যে টাকাপয়সা দেন, সাহায্য করেন–সেই কথা।
কেন?
ফিরিশতার কিসিমের মানুষ, জানাজানি করতে চান না মনে হয়।
গেলেই টাকা দেন?
জয়নাল একটু আমতা আমতা করে বলল, গেলেই সব সময় দেন না। মাঝে মাঝে দেন। কেউ বেশি কেউ কম?
কেউ বেশি কেউ কম?
জে।
কেন?
জয়নাল মাথা নেড়ে বলল, খান সাহেবের ইচ্ছা!
আমি তবু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, যার বেশি। দরকার তাকে বেশি?
জে না। সেইভাবে না।
তাহলে কিভাবে?
নাওয়াজ খান সাহেব আগে সবাইকে টিপে টুপে পরীক্ষা করেন। তারপর রক্ত পরীক্ষা করেন। এক্স-রে করেন। একটা ছোট বোতলে পেশাব করে দিতে হয়। সেই সব কিছু পরীক্ষা করেন। একটা কাগজে তারপর নাম ঠিকানা লিখেন। ক্যামেরা দিয়ে ফটো তুলেন তখন। তারপরে–
তারপরে কি?
তারপরে টাকা দেন। কেউ বেশি কেউ কম। খালি একটা শর্ত।
কি শর্ত?
যখন নাওয়াজ খান সাহেব খবর পাঠাবেন তখন যেতে হবে।
আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
জানি না। সব ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখেন মনে হয়।
তুই কি বেশি পেয়েছিস না কম?
জয়নাল দাঁত বের করে হেসে বলল, বেশি।
আমি জয়নালের কথা শুনে একটু অবাক হলাম। নানা রকম সন্দেহ হল, কিন্তু একটা ছেলের রক্ত, কফ, পেশাব পরীক্ষা করা, এক্স-রে –এর মাঝে সন্দেহ করার কি আছে? কে জানে, আসলেই নাওয়াজ খান মানুষটা হয়তো ফিরিশতার মত। মানুষের উপকার করতে চান, গরিব বাচ্চাদের সাহায্য করতে চান। বাবাকে দেখে আমার মনে হয় মন বিষিয়ে গেছে, সব মানুষকেই শুধু সন্দেহ করি।
জয়নাল মুখ কাচুমাচু করে বলল, আপনি কাউকে বলবেন না তো?
না।
খোদার কসম?
খোদার কসম।
জয়নালের মুখটা আবার তখন হাসি হাসি হয়ে গেল। পিচিক করে একবার থুতু ফেলে বলল, নাওয়াজ খান সাহেব বলেছেন, জানাজানি হয়ে গেলে আর এক পয়সাও দিবেন না।
ভয় পাস না। জানাজানি হবে না।
.
আমি জয়নালের মানি অর্ডার ফরম লিখে তার চিঠিটাও লিখে দিলাম। চিঠি লিখে লিখে তার ভাইবোন সবার নাম, কে কি করে, সবকিছু আমার জানা হয়ে গেছে। বাবা নেই, বড় ভাই একটা অপদার্থ, টাকাপয়সা নষ্ট করে। বার বার চিঠিতে তার মাকে সেটা সাবধান করে দেয়। ছোট একটা বোন, রওশন, স্কুলে যায়, খুব পড়াশোনার শখ। রওশনের জন্যে তার খুব মায়া। সে যেন স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে, সেটা বারবার করে লিখতে থাকে। যেহেতু সে নিজে লেখাপড়া জানে না, তার চিঠি লিখে দেয়া খুব শক্ত ব্যাপার। একটা কথাই সে বারবার বলতে থাকে। কথায় গুরুত্ব দেয়ার জন্যে মুখে। একটা কথা কয়েকবার বলা যায়। কিন্তু চিঠিতে একটা কথা কয়েকবার আবার কেমন করে লিখে? কিন্তু জয়নালের চিঠিতে সেটাই করতে হয়। তাকে বুঝিয়েও কোন লাভ হয় না। আজকে এক জাগায় লিখতে হল
.. রওশনের দিকে বিশেষ নজর দিবেন। বিশেষ নজর দিবেন। স্কুলে যেন। সময়মত যায়। পড়ালেখা যেন করে। সেই জন্য বিশেষ নজর দিবেন। পড়ালেখায় নজর দিবেন। স্কুলে যেন যায়। সেই দিকে বিশেষ নজর দিবেন। বইপুস্তক লাগিলে কিনিয়া দিবেন। টাকা পাঠাইলাম। বইপত্র কিনিবেন। বিশেষ নজর দিবেন … আমি আজকাল আর আপত্তি করি না, যাই বলে তাই লিখে দিই। চিঠি লেখা শেষ হলে তাকে পড়ে শোনাতে হয়। সে তখন খুব গম্ভীর হয়ে মাথা নেড়ে বলে, মনির ভাই, আপনি খুব ভাল চিঠি লিখেন। একেবারে ফাস কেলাশ।
০৫. গাছঘর
অংক ক্লাসে সলীল ফিসফিস করে বলল, একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।