কোন ক্লাসে পড়?
সেভেন।
ভেরী গুড। ভেরী গুড। লোকটার মুখ কেন জানি খুব খুশি খুশি দেখাতে থাকে। ক্লাস সেভেনে পড়া কেন এত খুশির ব্যাপার আমি ঠিক ধরতে পারলাম না।
নাম কি তোমাদের?
আমি সলীল।
আমি মুনীর।
ভেরী গুড। ভেরী গুড। লোকটা মনে হল আরো বেশি খুশি হয়ে গেল। মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, আমার নাম জহুরুল চৌধুরী। প্রফেসর জহুরুল চৌধুরী।
জহুরুল নামটা সলীল ঠিক ধরতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, প্রফের জারুল চৌধুরী?
লোকটা হা হা করে হেসে উঠে বলল, জারুল? ভালই বলেছ। জারুল! জারুল চৌধুরী! প্রফেসর জারুল চৌধুরী। হা হা হা …
আমি সলীলকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, গাধা! জারুল না, জহুরুল। জহুরুল চৌধুরী। ও। ও। সলীল একটু লজ্জা পেয়ে বলল, জহুরুল
লোকটি, মাথা নেড়ে সলীলকে থামিয়ে দিয়ে বলল, না না, জারুলই ভাল! চমৎকার নাম। গাছের নামে নাম। জারুল চৌধুরী খুব ভাল শোনায়! কি বল?
বোঝাই যাচ্ছে মানুষটা একটু পাগলা গোছের, কিন্তু ভাল মানুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। লোকটা হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ থেকে তোমাদের কাছে আমার নাম জারুল চৌধুরীই হোক। প্রফেসর জারুল চৌধুরী।
আমি একটু ইতঃস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কিসের প্রফেসর?
আমি ম্যাথমেটিক্সের প্রফেসর। গণিতশাস্ত্রের। অংকের। অংক ভাল লাগে তোমাদের?
অংক ভাল লাগে সেরকম কোন মানুষ কি সত্যি হওয়া সম্ভব? আমরা তবু ভদ্রতা করে মাথা নাড়লাম, বললাম, জী। ভাল লাগে।
ক্লাস সেভেনে কি অংক শেখায় তোমাদের? ক্যালকুলাস?
আমরা মাথা নাড়লাম, না।
প্রফেসর জারুল চৌধুরী মনে হল খুব অবাক হলেন। ক্যালকুলাস শেখায় না? ভারি আশ্চর্য। যত ছোট থাকতে সম্ভব ক্যালকুলাস শেখানো উচিৎ। ছোটরা শিখবে খুব সহজে। আমি ভেবেছিলাম একটা বই লিখব, নাম দিব ”শিশুদের ক্যালকুলাস”।
প্রফেসর জারুল চৌধুরী তার বইয়ের বিষয়বস্তু কি হবে সেটা আমাদের বোঝাতে শুরু করলেন। আমরা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তবু মাথা নাড়তে থাকলাম।
কেতলিতে পানি গরম হয়ে যাবার পর প্রফেসর জারুল চৌধুরী আমাদের টিনের মগে চা তৈরি করে দিলেন। একটা প্যাকেট থেকে খানিকটা মুড়ি বের করে দিয়ে বললেন, স্কুল থেকে এসেছ, নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। আমার কাছে তো মুড়ি ছাড়া। আর কিছু নাই। মুড়ি খাও তো তোমরা?
জী খাই।
আমরা মুড়ি খেতে খেতে চায়ে চুমুক দিলাম। টিনের মগে চা খেতে হয় খুব। সাবধানে, ঠোঁট পুড়ে যায় খুব সহজে। চায়ে কি চমৎকার গন্ধ! মনে হল পায়েশ খাচ্ছি। আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, আপনি কলেজের প্রফেসর?
হুঁ। প্রফেসর জারুল চৌধুরী মাথা নাড়লেন, এক সময়ে ছিলাম। এখন আর না।
রিটায়ার করেছেন?
বলতে পার এক ধরনের রিটায়ার।
আমরা চা খেতে খেতে প্রফেসর জারুল চৌধুরীর সাথে কথা বলতে লাগলাম। একজন প্রফেসর, তাও যাতা প্রফেসর না, অংকের প্রফেসর, আমাদের সাথে। এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমরা ছোট নই, তাঁর সমবয়সী! আমরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
আমরা হয়তো আরো কিছুক্ষণ কথা বলতাম কিন্তু হঠাৎ টেবিলের নিচে পা লেগে কি একটা পড়ে গেল, আমি মাথা নিচু করে দেখি, একটা ছোট বাক্স, ভিতরে ভাঙা। কাঁচের বোতল। জারুল চৌধুরী বললেন, ওটা কিছু নয়। ভাঙা কাঁচের টুকরা। ঘরের ভিতরে রাখাই ঠিক হয়নি।
ভাঙা কাঁচ দিয়ে কি করবেন?
সূতায় মাঞ্জা দেব।
আমি আর সলীল চোখ বড় বড় করে তাকালাম, কিসে মাঞ্জা দেবেন?
সূতায়। ঘুড়ির সূতায়। ঢাউস একটা ঘুড়ি কিনে এনেছি, এই এত বড়, জারুল চৌধুরী দুই হাত দিয়ে দেখালেন।
হঠাৎ করে আমার একটা সন্দেহ হতে থাকে, মানুষটা নিশ্চয়ই পাগল। তা না হলে এরকম বয়স্ক একজন মানুষ সূতায় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি উড়ায়? হাতে দামী ঘড়ি পরে, গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাখে? আমাদের মত বাচ্চা ছেলেদের সাথে এরকম ভাল ব্যবহার করে? আমি আড়চোখে সলীলের দিকে তাকালাম, দেখি তার মুখও কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, সেও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে। ঢোক গিলছে একটু পর পর।
চা প্রায় শেষ হয়ে আসছিল, আমি ঢকঢক করে বাকিটা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমাদের যেতে হবে। দেরি হয়ে গেছে।
সলীলও সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
জারুল চৌধুরী বাইরে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, মনে হয় দেরি হয়ে গেছে।
আমরা মাথা নেড়ে বইপত্র হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভয় হচ্ছিল, হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ বুঝি ক্ষেপে উঠে চিৎকার করে লাফিয়ে পড়বে। হাতে থাকবে একটা রাম দা, এক কোপে আমাদের গলা আলাদা করে দেবে। কিন্তু সেরকম কিছু। হল না। আমাদের ভাল মানুষের মত দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে। সলীল আর মুনীর, বাসায় যাও এখন। খুব ভাল লাগল তোমাদের সাথে কথা বলে।
আমি আর সলীল গুটিগুটি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। নদীর ঘাটে এসে সলীল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মানুষটা আসলে পাগল। তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম। কেমন জানি আমার একটু মন খারাপ হল।
.
বাসায় এসে দেখি, ট্রেন ফেল করেছেন বলে বাবা ঢাকা যেতে পারেননি। আমাকে দেখে তার চোখ কেমন জানি চকচক করে উঠল। মুখে লোল টেনে বললেন, আয় হারামজাদা, আজ বাসায় আয়! কখন স্কুল ছুটি হয়েছে আর তুই এখন বাসায় আসিস? আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।