নদীর তীর ধরে হেঁটে হেঁটে কদমতলা পর্যন্ত এসে ব্রীজের ওপর দিয়ে হেঁটে নদী পার হয়ে এলাম। নদীর এপাশে আরো অনেকদূর হেঁটে লাশকাটা ঘর পার হয়ে চাঁদমারী। পাহাড়ের পিছন দিয়ে গিয়ে, দুটো সর্ষে ক্ষেতের পর ছোট খালটা পার হয়ে বেশ জংলা মতন একটা জায়গায় সলীল এসে থামল। অকারণে গলা নামিয়ে বলল, এটা সাহেব বাড়ি।
বাড়ি কই?
ঐ যে দেখিস না?
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যিই গাছপালার ভিতরে একটা পুরানো দালান। দেখে মনে হয় ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। চারিদিক থেকে গাছ বের হয়ে এসেছে লতাপাতায় ঢাকা। দেখেই কেমন জানি না গা ছমছম করতে থাকে। সলীল ফিসফিস করে বলল, কি সাংঘাতিক না?
আমি মাথা নাড়লাম।
আয়, আরেকটু কাছে যাই।
কার বাড়ি এটা।
জানি না।
কেউ থাকে এখানে?
ধুর! কেমন করে থাকবে? দেখিস না এটা পোড়াবাড়ি। কি রকম ছমছমে দেখেছিস? কি সাংঘাতিক! তাই না?
আমি আবার মাথা নাড়লাম।
আয় ভিতরে যাই। ভিতরে?
আমি চমকে উঠে বললাম, ভিতরে যাবি?
কেন যাব না? দেখে আসি।
আমার ঠিক ইচ্ছে হচ্ছিল না কিন্তু তবু সলীলের উৎসাহে এগিয়ে গেলাম। বাসার। পিছন দিকে একটা ভাঙা সিঁড়ি পাওয়া গেল, গাছপালা লতাপাতায় ঢাকা। সলীল বলল, চল উপরে উঠি।
কার না কার বাসা!
কেউ থাকে না এখানে। আর আমরা তো চুরি করতে যাচ্ছি না, দেখতে যাচ্ছি।
আমি বাধ্য হয়ে সলীলের সাথে সাথে ওপরে উঠতে থাকি। ওপরে একটা বারান্দা। মত পাওয়া গেল। সেখান দিয়ে আরেকটা সিঁড়ি বেয়ে মনে হল ছাদের দিকে যাওয়া যায়। দুজনে রওনা দিয়েছি, হঠাৎ করে কে যেন কানের কাছে বলল, কি খোকা, কাকে চাও?
আমি আর সলীল এমন চমকে উঠলাম সে আর বলার মত নয়। আরেকটু হলে এত জোরে লাফিয়ে উঠতাম, নিশ্চয়ই একেবারে ছাদে মাথা ঠুকে যেতো। অনেক কষ্টে নিজেদের শান্ত করে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, একজন অদ্ভুত মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা শুকনো মতন, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা, মাথায় কাঁচা পাকা চুল। দেখে মনে হয়, কলেজের প্রফেসর কিন্তু গায়ের জামা কাপড় বাচ্চা ছেলেদের মত! রঙিন একটা শার্ট, তার সবগুলি বোতাম খোলা। ভিতরে একেবারে অসম্ভব পরিষ্কার একটা গেঞ্জি, যেন এইমাত্র কিনে এনে পরেছে। নীল রঙের ভুসভুসে একটা প্যান্ট, পায়ে টেনিস শু। হাতে খুব চকচকে একটা ঘড়ি, দেখে মনে হয় খুব দামী। মানুষটাকে একই সাথে খুব শিক্ষিত একজন ভদ্রমানুষ আবার কেমন জানি পাগল পাগল মনে হচ্ছে। সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে একটা লাল গামছা, যেটা তার গলা থেকে ঝুলছে। রিকশাওয়ালা, কুলী বা চাষীরা যেভাবে গামছা ঝুলিয়ে রাখে সেরকম।
আমাদের খানিকক্ষণ লাগল সামলে নিতে। সলীল সামলে নিল আগে, আমতা আমতা করে বলল, না মানে ইয়ে–
কাউকে খোঁজ করছ? লোকটার গলার স্বর খুব ভাল। টেলিভিশনে যারা খবর পড়ে তাদের মত।
সলীল আবার মাথা নাড়ল, উঁহু। কাউকে খোঁজ করছি না।
আমি ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। এখনই নিশ্চয়ই বাজখাই গলায় একটা ধমক দেবে, সেই ধমকে আমরা নিশ্চয়ই দিশেহারা হয়ে ছুটে পালাব। কিন্তু লোকটা ধমক দিল না। বরং মনে হল একটু হেসে দিল। হেসে বলল, তোমরা কারা? এখানে কি মনে করে?
আমি বললাম, ইয়ে, মানে—
কোন কাজে, নাকি এমনি?
এমনি।
বেশ বেশ। লোকটা চশমা খুলে তার লাল গামছা দিয়ে খুব যত্ন করে তার চশমাটা পরিষ্কার করতে শুরু করল। তারপর আবার চোখে দিয়ে বলল, কাজের অনেক সময় পাবে বড় হলে। এখন এমনিতেই ঘুরোঘুরি কর। সেটাই ভাল।
লোকটাকে বদমেজাজি মনে হচ্ছে না, হয়তো ধমক দিয়ে আমাদের বিদায় করে দেবে না। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে থাকেন?
আমি? সব সময় থাকি না। মাঝে মাঝে থাকি।
সলীলের চোখ চকচক করে উঠে, কি সুন্দর বাসা!
সুন্দর? লোকটি অবাক হয়ে সলীলের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। কি সুন্দর চারিদিকে। গাছপালা নির্জন সুমশাম!
নির্জন? সুমশাম?
হ্যাঁ। এটা কি আপনার নিজের বাসা?
আমার পূর্বপুরুষের ছিল। এখন আমার। কিছুদিনের জন্যে আমার।
তারপরে?
তারপরে জানি না কি হবে। লোকটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর লাল গামছা দিয়ে মুখ মুছে বলল, এখন আমার চা খাওয়ার সময়। তোমরা কি খাবে এক কাপ চা আমার সাথে?
আমি সলীলের দিক তাকালাম। একেবারে অপরিচিত একজন মানুষের সাথে চা খাওয়া কি ঠিক হবে? বাবাকে দেখেই কিনা জানি না, বড় মানুষদের আমার কেন জানি বিশ্বাস হয় না, শুধু মনে হয়, নিশ্চয়ই কোন রকম বদ মতলব আছে। এই লোকটাকে দেখে অবিশ্যি কেমন জানি ভাল মানুষের মত মনে হচ্ছে। আমরা তাই আর না করতে পারলাম না। লোকটির পিছনে হেঁটে হেঁটে পাশের একটা ঘরে ঢুকলাম। বাইরে থেকে দেখে যেরকম মনে হয় বাসাটি ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, ভিতরে কিন্তু সেরকম খারাপ না। ঘরের মাঝে কোন আসবাব নেই, মাঝখানে শক্ত একটা কাঠের টেবিলের উপরে একটা স্টোভ, সেই স্টোভে কুচকুচে কালো একটা কেতলি। লোকটি স্টোভটা বারকয়েক পাম্প করে জ্বালিয়ে দিল, শো শো শব্দ করে সেখান থেকে নীল আগুন বের হতে থাকে। কেতলিতে খানিকটা পানি ভরে লোকটি স্টোভের উপর চাপিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুল থেকে আসছ?
আমাদের হাতে বই, কাজেই আমরা যে স্কুল থেকে আসছি বোঝা খুব কঠিন নয়। আমরা মাথা নাড়লাম।