তুই কেমন করে জানিস?
বাবার কাছে শুনেছি। বাবা ভাটি এলাকা থেকে এসেছে। যদি সেখানে না যেতে চাস তাহলে সমুদ্রে যেতে পারি। ট্রলারে করে মহেশখালি, না হয় কুতুবদিয়া, না হয়। সেন্ট মার্টিন্স, নীল জল, দূর পাহাড়ে! আহ! সলীল জিব দিয়ে এরকম শব্দ করল, মনে হল যেন পুরো দৃশ্যটা চেখে খাচ্ছে।
সমুদ্রে যদি যেতে না চাস –সলীলের চোখ হঠাৎ আবার চকচক করতে থাকে, তাহলে আমরা বেদে নৌকা করে যেতে পারি। বেদের নৌকা দেখিসনি? সাপের ঝাপি নিয়ে আসে। তাদের সাথে ঘুরে বেড়াবি। সাপের খেলা দেখাবি! সাপের মন্ত্র বিক্রি করবি!
বেদের নৌকা? আমি অবাক হয়ে বললাম, তোকে নেবে কেন?
কেন নেবে না?
তুই কি বেদে?
বেদে হয়ে যাব।
আমি হি হি করে হাসলাম, ধুর গাধা! ইচ্ছে করেলই কি বেদে হওয়া যায়? সলীল কেমন জানি আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে হঠাৎ মনে হয় বেদে হয়ে জন্ম হয়নি বলে তার জীবনে বুঝি খুব বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেছে।
০৩. সাহেব বাড়ি
রশীদ স্যার আমাদের ইতিহাস পড়ান। আসল ইতিহাস মনে হয় খারাপ না, কিন্তু আমাদের ক্লাসে যে জিনিসটা পড়ানো হয় তার থেকে জঘন্য আর কিছু হতে পারে না, রাজা বাদশাহ নিয়ে বানানো সব গালগল্প! সলীল একবার কোথা থেকে একটা বই জোগাড় করে এনে দিয়েছিল, বইয়ের নাম ”প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতা”, সে যে কি সাংঘাতিক একটা বই! পড়লে মনেই হয় না ইতিহাস পড়ছি, মনে হয় রহস্য উপন্যাস পড়ছি। মিশরের ফারাওদের কাহিনী, কেমন করে মমি তৈরি করত তার ইতিহাস, দক্ষিণ আমেরিকার মায়াদের কাহিনী, কেমন করে প্রত্যেকদিন হাজার হাজার মানুষের বুক কেটে হৃদপিণ্ড বের করে সূর্য দেবতাকে উৎসর্গ করত তার বর্ণনা, রোমানদের গল্প, ক্রীতদাসের বিদ্রোহের কি সাংঘাতিক একটা কাহিনী! কিন্তু আমাদের ক্লাসে সেসব কিছুই পড়ানো হয় না। রশীদ স্যার মনে হয় ব্যাপারটা টের পেয়েছেন, তাই আমাদের কিছু পড়ানোর চেষ্টা করেন না। ক্লাসে এসে চেয়ারে দুই পা তুলে একটা বিচিত্র ভঙ্গিতে বসে পড়েন, দেখে মনে হয় এভাবে বসতে বুঝি খুব আরাম। তারপর ইতিহাস বইটা হাতে নিয়ে বলেন, বাহান্ন পৃষ্ঠা থেকে ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড় মনে মনে। গোলমাল করবি না। খবরদার।
আমরা প্রথমে একটু সময় পড়ি, তারপর নিজেরা নিজেরা ফিসফিস করে কথা বলি, চুপি চুপি চোর পুলিশ খেলি। যাদের কাছে ডিটেকটিভ বই আছে ইতিহাস বইয়ের উপর রেখে পড়তে শুরু করি। মজিদ স্যার মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে বলেন, কোন কথা না, খবরদার।
আমরা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার কথা বলতে শুরু করি। কোন রকম কথা না বলে কেমন করে থাকে একজন মানুষ? সলীল আমার পাশে বসেছিল, গলা নামিয়ে বলল, এক জায়গায় যাবি আজ?
কোথায়?
সাহেব বাড়ি।
সেটা কোনখানে?
মজিদ স্যার আবার হুঙ্কার দিলেন, খবরদার, আর কোন কথা না। জবাই করে ফেলব।
সলীল তাই আর কথা বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে বুঝিয়ে দিল সাহেব বাড়ি হচ্ছে রহস্যময় এক বাড়ি।
.
সলীলের এটা প্রায় নেশার মত হয়ে গেছে। রহস্যময় জিনিসের জন্যে সে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়! রহস্যময় সব জিনিসে তার শখ। সত্যিকারের রহস্যময় জিনিস আর কয়টা আছে? কিন্তু সলীলের জন্যে সেটা কোন সমস্যা না, সাধারণ একটা জিনিসকে সে সাংঘাতিক একটা রহস্যময় জিনিস হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারে। সবার কাছে যেটা মনে হয় জংলা জায়গায় ভাঙা একটা বাড়ি সলীল সেটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। তার চোখ চকচক করতে থাকে, উত্তেজনায় কথা বলতে পারে না। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে, ইশ! কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক!
সলীলের সাথে ঘুরে ঘুরে আমারও এখন একটু অভ্যাস হয়েছে। ব্যাপারটা আসলে কঠিন না। প্রথমে অনেক বই পড়তে হয়। বইয়ে নানা রকম বিচিত্র কাহিনী থাকে, সেগুলি জানা থাকলে কল্পনা করা খুব সোজা। ভাঙা একটা বাড়ি দেখে সলীল বলে, দেখ, দেখ একেবারে আজটেক মন্দিরের মত!
আমিও মাথা নেড়ে বলি, হ্যাঁ, ঐ ওপরে নিশ্চয়ই পুরোহিত দাঁড়াত পাথরের চাকু নিয়ে?
হ্যাঁ, আর ঐ বারান্দায় মানুষকে শোওয়াতো বলি দেয়ার জন্যে। মানুষ আর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকত চারিদিকে। হাত তুলে গান গাইত —
আমি আর সলীল তখন বিচিত্র একটা শব্দ বের করতে শুরু করে দিই, যেন প্রাচীন মানুষ গান গাইছে! ব্যাপারটা খারাপ না।
সলীলের রহস্যময় বাড়িটাও সেরকম একটা কিছু হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে হয় সেখানে যাওয়াটা খারাপ না। আজ হাফ স্কুল, দুপুরে ছুটি হয়ে যাবে। সন্ধ্যের ট্রেনে বাবা ঢাকা ফেরৎ যাবে, তার আগে এমনিতেই বাসায় ফিরে যাওয়ার তো কোন মানেই হয় না। খামাখা আরেক চোট মার খাওয়া।
স্কুল ছুটির পর আমি আর সলীল নদীর তীর ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। নদীর মনে হয় এক ধরনের যাদু আছে। এর কাছে আসলেই মন ভাল হয়ে যায়। এর কারণটা কি কে জানে? মনে হয় অনেক খোলামেলা, অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায় সে জন্যে। যখন বড় কোন নৌকা যায় তখন আমি আর সলীল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, কি যে ভাল লাগে দেখতে! মাঝিরা দাঁড় টানছে, বড় লগি দিয়ে দুজন দুপাশ থেকে ঠেলছে, বুড়ো মাঝি শক্ত করে হাল ধরে রেখেছে। নৌকার মাঝেই এক কোণায় একজন রান্না বসিয়েছে, কি আশ্চর্য রহস্যময় ব্যাপার!