আমাদের ক্লাসে তিন নম্বরের ছেলেরা হচ্ছে ডানপিটে ধরনের ছেলে। তারা শার্টের হাতা উল্টো করে ভঁজ করে রাখে, তাদের চুল ঝাউ গাছের মত উঁচু হয়ে থাকে। তারা। সাধারণত পড়াশোনা করে না, অবসর সময়ে তারা সিনেমার নায়িকাঁদের নিয়ে গল্প করে। ক্লাসে যখন স্যার থাকেন না তারা তখন নিরীহ ছেলেগুলিকে জ্বালাতন করে।
আমি প্রথমে চেষ্টা করেছিলাম এক নম্বর ছেলেদের দলে যেতে, সেটা সম্ভব হল না। দেখলাম, আস্তে আস্তে দুই নম্বর দলে চলে যাচ্ছি। তাই কয়দিন থেকে চেষ্টা করছি তিন নম্বর দলে যেতে। ব্যাপারটা যত সোজা ভেবেছিলাম আসলে তত সোজা না। তিন নম্বর দলে থাকলে মাঝে মাঝে কাঁঠাল গাছের নিচে বসে সিগারেট টানতে হয় আমি জানতাম না।
আমাদের ক্লাসে শুধু একটা ছেলে আছে যে একই সাথে তিন দলেই থাকতে পারে। সেটা হচ্ছে সলীল। এমনিতে পড়াশোনা করে না, গত বছর হঠাৎ দুম করে পরীক্ষায় থার্ড হয়ে গেল। অংকে ৯৮, ইংরেজিতে ৮৪। আমরা একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম, কিন্তু সলীল দেখি মোটেও অবাক হল না, বরং তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল সেটাই খুব স্বাভাবিক। কিন্তু পরীক্ষায় থার্ড হয়েও সে এক নম্বর দলে গেল না। এক নম্বর দলে যেতে হলে বড়লোকের ছেলে হতে হয়, পরিষ্কার কাপড় পরতে হয়, সবচেয়ে বড় কথা, বাবাদের জজ ম্যাজিস্ট্রেট হতে হয়। সলীলের বাবা তালেব উঁকিলের মুহুরী। তার বাবা বড়লোক না হলেও সলীলের চেহারা খুব ভাল। গতবার স্কুলে যখন নাটক হল স্যারেরা তাকে রাজপুত্রের পার্ট দিয়েছিলেন শুধু চেহারা দেখে। সে আবার নিরীহ দলের না। যেদিন কাসেম সলীলের ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, এই মালাউনের বাচ্চা, সলীল কোন কথা না বলে কাসেমের কলার ধরে তাকে দরজার সাথে ঠেসে ধরে বলল, রাজাকারের ছাও, আরেকবার এই কথা বলবি তো এক ঘুষিতে দাঁত খুলে নেব।
কাসেম তিন নম্বর দলের, আমাদের ফুটবল টিমের হাফ ব্যাক। তার গায়ে হাত দিতে সাহস দরকার, শক্তিরও দরকার। সলীলের সাহস আছে সেটা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। শক্তি আছে কিনা সেটা কোনদিন ভাল করে প্রমাণ হয়নি। মনে হয় সেটা পরীক্ষা করে দেখার মত সাহস কারো নেই।
সলীলের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব আছে। আমার যেরকম গল্প বই পড়ার শখ সলীলেরও তাই। ছোটদের পড়া নিষেধ উপন্যাসগুলি সলীল জানি কিভাবে কিভাবে জোগাড় করে আনে। নিজে রাত জেগে পড়ে, পড়া শেষ হলে আমাকে পড়তে দেয়, আমি ছাদে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। বাবা এমনিতেই যা মারতে পারেন, এরকম একটা উপন্যাস পড়তে দেখলে যে আমার কি অবস্থা করবেন চিন্তা করলেই কাল ঘাম ছুটে যায়।
মোটাসোটা জমজমাট একটা উপন্যাস পেলেই সলীল আমার জন্যে আলাদা করে রাখে। আজকেও অংক ক্লাসের ফাঁকে খবরের কাগজে মোড়া একটা বই আমার দিকে
এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এক নম্বর জিনিস।
বইটার নাম ‘নীল নয়নার অভিসার’। আমি বইটা উল্টেপাল্টে দেখে একটা নিঃশ্বাস। ফেলে ফেরৎ দিয়ে বললাম, এখন না।
সলীল অবাক হয়ে বলল, কেন?
বাবা এসেছে। এক সপ্তাহ থাকবে।
সত্যি?
হ্যাঁ। আমি শার্টের কলার সরিয়ে দেখালাম। শিউলী গাছের ডাল দিয়ে মেরে বাবা কেমন করে গলার কাছে রক্ত জমিয়ে ফেলেছেন।
সলীল ভুরু কুচকে মাথা নাড়ল, কিছু বলল না। এই জন্যে সলীলকে আমার ভাল লাগে, তার ভিতরে মনে হয় একটু মায়াদয়া আছে। অন্য যে কেউ হলে দাঁত বের করে হেসে বলত, এই, দেখ দেখ, মুনীরকে তার বাবা কেমন বানিয়েছে! সবাই তখন ছুটে আসত দেখার জন্যে যেন কত বড় মজা হয়েছে।
টিফিনের ছুটিতে সলীল শার্টের কলার সরিয়ে গলাটা আরেকবার দেখে বলল, এইভাবে মারল? কি করেছিলি?
কিছু না।
কিছু না?
না।
ভগবানের কীরা? ভগবানের কীরা।
খোদার কসম।
সলীল অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, তোর বাবার নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল আছে।
কি গোলমাল?
স্যাডিস্টিক।
সেটা কি জিনিস?
যারা অন্য মানুষকে অত্যাচার করে আনন্দ পায়। আমি বইয়ে পড়েছি। এটা হচ্ছে স্যাডিস্টিক ব্যবহার।
ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না। সলীল আমার থেকে অনেক বেশি বই পড়ে, এই সব ব্যাপার কোন বইয়ে পড়ে ফেলবে, বিচিত্র কি। বাবার মেরে আনন্দ পাওয়ার ব্যাপারটির। একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে জানার পরও অবিশ্যি আমার খুব একটা স্বস্তি হল না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, মনে হয় কোনদিন বাসা থেকে পালিয়ে যেতে হবে।
সলীল হঠাৎ আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?
সত্যি।
আমারও মাঝে মাঝে এত ইচ্ছা করে পালিয়ে যেতে।
কেন? তুই কেন পালিয়ে যাবি? তোর বাবা কি পেটায়?
না, সেরকম কিছু না। কিন্তু অন্য রকম অশান্তি আছে।
কি অশান্তি?
এই কত রকম অশান্তি –সলীল হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান। করল। নিশ্চয়ই আমাকে বলতে চায় না, আমি তাই আর জোর করলাম না।
সলীল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, সত্যি পালাবি?
আমি একটু অবাক হয়ে সলীলের দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটি কেমন জানি চকচক করছে। দেখে আমার কোন সন্দেহ হল না যে সলীল সত্যি সত্যি কোথাও পালাতে চায়। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পালাবি?
কত জায়গা আছে! গয়না নৌকা করে ভাটি এলাকায় যেতে পারি। কি সুন্দর! দেখলে তোর মাথা খারাপ হয়ে যাবে। একেবারে কাঁচের মত জল, নিচে দেখবি গাছপালা ঝোঁপঝাড়। মাইলের পর মাইল —