নাওয়াজ খান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখন আমি বাথরুমের সুইচটা অন করে দিলাম, কোথায় জানি ভট করে একটা শব্দ হল আর সাথে সাথে সমস্ত ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। সলীল আর জয়নাল বিদ্যুগতিতে লাফিয়ে উঠে, দড়িতে বাধা বোতলটা ঘুরিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে দুজনকে, ঠাস করে একটা শব্দ হল আর আমি প্রথমে নাওয়াজ খান তারপর ওসমানের চিৎকার শুনতে পেলাম। ধড়াস করে। কেউ একজন পড়ে গেল, আমি সাথে সাথে প্রচণ্ড লাথি আর ঘুষির শব্দ শুনতে পেলাম। আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে হাত লাগালাম, অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না, দুজন মনে হয় উবু হয়ে পড়ে আছে, প্রচণ্ড জোরে লাথি হাকালাম, কঁক করে শব্দ করে উঠল একজন। সলীল বলল, এখন বাইরে চল, কাজ শেষ–
জয়নাল লাথি মারতে মারতে বলল, আমি জানে মেরে ফেলব শুওরের বাচ্চাদের–
মাথা গরম কর না জয়নাল, সলীল জয়নালকে ধাক্কা দিয়ে বের করতে করতে বলল, আগে নিজের জান বাচাও।
আমরা ছুটে বাইরে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ছিটকিনিটা টেনে দিলাম। হঠাৎ মনে হল, আর পায়ে জোর নেই, হাটু ভেঙে বসে পড়লাম তিনজন! বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকি, মনে হয় বুক একেবারে ফাঁকা হয়ে আছে বাতাসের জন্যে। কি ভয়ংকর বিপদের হাত থেকেই না বেঁচে এসেছি!
ঘরের ভিতর থেকে নাওয়াজ খানের গলা শুনতে পেলাম। কেমন যেন ভাঙা গলায় বললেন, ওসমান! কি হল এটা ওসমান? কি হল?
ওসমান কোন কথা বলল না, কেমন যেন গোঙানোর মত শব্দ করল। ভিতর থেকে তারা দরজায় ধাক্কাধাক্কি করতে থাকে, শক্ত ভারি দরজা, কিছু করতে পারবে মনে হয় না।
আমি ফিসফিস করে বললাম, চল পালাই।
জয়নাল বলল, যদি পালিয়ে যায়?
নাওয়াজ খান ভিতর থেকে বলল, এই যে ছেলেরা তোমরা দরজাটা খুলে দাও, প্লীজ! যদি খুলে দাও তাহলে–
তাহলে কি?
তোমাদের এত টাকা দেব যে তোমরা—
জয়নাল হিসহিস করে বলল, তোর টাকায় আমি পিশাব করে দিই।
আমি জয়নাল আর সলীলকে টেনে কোন মতে নিচে নামিয়ে আনি। পিছনে নাওয়াজ খান তখনো আমাদের ডাকাডাকি করে যাচ্ছে।
.
বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। পুলিশকে বলতে হবে কিন্তু ঠিক কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। পুলিশ কি আমাদের কথা শুনবে? শুনলেও কি বিশ্বাস করবে?
ঠিক তখন দেখি ছাতা মাথায় লম্বা লম্বা পা ফেলে একজন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মানুষটি কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। হাতে একটা টর্চলাইট, সেটা। আমাদের পায়ের কাছে জ্বালিয়ে বলল, কে? মুনীর? সলীল?
আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, জারুল স্যার! জারুল স্যার!
ভাল আছ তো তোমরা?
জি স্যার! ভাল আছি! চিঠি পেয়েছেন আমাদের?
হ্যাঁ, চিঠি পেয়েই তো আসছি! চিঠিতে লিখেছ—
ধরে ফেলেছি স্যার!
ধরে ফেলছে? জারুল চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন, কি ধরে ফেলেছ?
নাওয়াজ খান আর ওসমানকে। জয়নালকে বেঁধে রেখেছিল, ছুটিয়ে এনেছি! সলীলকেও ধরে ফেলেছিল–
কি বলছ তোমরা?
খোদার কসম! আমি হড়বড় করে কথা বলতে থাকি, সলীল আমাকে থামিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করে, জয়নাল তার মাঝে হুংকার দিয়ে বলে, জবাই করে ফেলব। বদমাইশের বাচ্চাদের। জবাই করে ফেলব।
জারুল চৌধুরী কি হয়েছে বোঝার চেষ্টা করতে থাকেন। আমাদের চেঁচামেচিতে দেখতে দেখতে আমাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে উঠে। অন্য সময় হলে কেউ আমাদের কথা শুনত কিনা জানি না, কিন্তু এখন সবাই শুনছে। জারুল চৌধুরী খুব মন দিয়ে শুনছেন, সে জন্যেই হয়তো।
বুকটা হঠাৎ হালকা হয়ে যায়, আর আমাদের কোন ভয় নেই। জানে বেঁচে গেছি আমরা।
আহ! বেঁচে থাকা কি আনন্দের ব্যাপার!
১৪. পুলিশ
দৃশ্যটা খুব অদ্ভুত। নাওয়াজ খানের হাতে হাতকড়া লাগানো। হাতকড়া লাগানোর সময় হাতগুলি পিছনে কেন রাখা হয় কে জানে? তাকে একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে, হাজার হলেও একজন সম্মানী ডাক্তার মানুষ।
ওসমানের হাতেও হাতকড়া, কিন্তু তার জন্যে কোন চেয়ার নেই, সে বসেছে মেঝেতে। দুজনের মুখ খুব গম্ভীর, দেখে মনে হয় গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। নাওয়াজ খানের কপালটা ফুলে আছে, জয়নালের বোতল দিয়ে লেগেছে। ওসমানের বাম চোখটাও প্রায় বুজে এসেছে। অন্ধকারের সেই মারামারিতে কে কোথায় মার খেয়েছে বোঝা মুশকিল।
বড় একটা টেবিলের এক পাশে বসেছেন একজন পুলিশ অফিসার। মাঝবয়সী মানুষ, মুখে মোটা মোটা গোফ। দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করে। টেবিলের অন্য পাশে। বসেছেন জারুল চৌধুরী। তার মুখটাও খুব গম্ভীর। কারণটা কি কে জানে! জারুল চৌধুরীর অন্যপাশে তিনটা চেয়ারে বসেছেন আমার বাবা, সলীলের বাবা আর উকিল সাহেব। পুলিশ অফিসার গভীর রাতে কনেস্টবল পাঠিয়ে এই তিনজনকে ডেকে পাঠিয়েছেন। টেবিলের সামনে একটা বেঞ্চে আমি, সলীল আর জয়নাল চাপাচাপি করে বসেছি। আমাদের চারপাশে অনেক কয়জন পুলিশ, সবাই হাঁটাহাঁটি করছে, ব্যস্ততা নেই, কিন্তু হাঁটাহাঁটির মাঝে খুব একটা গুরুত্বের ভাব।
পুলিশ অফিসারটি টেবিলে একটা পেন্সিল ঠুকতে ঠুকতে বললেন, আমি অনেকদিন থেকে পুলিশে চাকরি করি কিন্তু এরকম কেস একটাও দেখিনি।
জারুল চৌধুরী বললেন, শুনে ভরসা পেলাম। এরকম কেস যে একটাও আছে সেটাই কি বেশি নয়?
তা ঠিক প্রফেসর সাহেব। পুলিশ অফিসার মাথা নাড়লেন, যদি এই ছেলেরা না ধরত, কোনদিন কি আমরা ধরতে পারতাম? পারতাম না। কোনদিনই পারতাম না।