কি কাজ?
সেটা জানতে চেয়ো না ছেলে। তোমার শুনতে ভাল লাগবে না। মেরে ফেলার কথা শুনতে কারো ভাল লাগে না।
সলীল কি একটা বলতে যাচ্ছিল, নাওয়াজ খান তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ওসমান।
জী।
এই পুরো ঝামেলাটা হল তোমার বোকামির জন্যে। যদি এই ছেলেটা ভিতরে না ঢুকতে পারত এই ঝামেলাটা হত না।
আমি বুঝি নাই স্যার। আমি মনে করেছি—
থাক। আমাদের হাতে সময় নেই। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে হবে। দুইটা কুলার রেডি কর।
দুইটা?
হ্যাঁ। একটাতে জয়নালের কিডনি, আরেকটা বোনাস, এই মাথামোটা ছেলের কিডনি। আর দুইটা বড় প্লাস্টিকের ব্যাগ বের কর। এদের ডেডবডি মনে হয় সাথে নিয়ে যেতে হবে। সত্যিই যদি পুলিশে খবর দিয়ে থাকে, কোন প্রমাণ রাখা ঠিক হবে না। আমি অপারেশন থিয়েটার রেডি করছি, তুমি মাইক্রোবাসটাও রেডি কর। আধ ঘন্টার মাঝে সব কাজ শেষ করে আমরা রওনা দেব।
ঠিক আছে স্যার। আর এই ছেলেটা?
এখন বেঁধে রাখ। মুখে সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে দাও যেন শব্দ করতে না পারে।
সলীল আবার কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল কিন্তু মনে হয় বলতে পারল না। খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তির মত শব্দ হল, তারপর এক সময় আমাদের এই ঘরটাতে সলীলকে ফেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
নাওয়াজ খান আর ওসমানের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই আমি বিছানার নিচ থেকে বের হয়ে সলীলের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, সলীল!
সলীল কোন শব্দ করতে পারল না, মুখ দিয়ে কেমন জানি গো গো করে শব্দ করল। আমি তার মুখের টেপটা খুলে দিতেই সে ফিসফিস করে বলল, মুনীর, তুই এখানে কি করিস? পালিয়ে গেলি না কেন?
একা একা কোথায় যাব! কি করব? কেউ কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?
তাহলে?
দাঁড়া, আগে তোদের তাড়াতাড়ি খুলে দিই। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। আমার তিনজন, তারা দুইজন, আর কিছু যদি না হয় গায়ের জোরে বের হয়ে যাব।
খুব শক্ত করে বেঁধেছে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে হাতের বাধন খুলতে অনেকক্ষণ সময় লাগল। বাইরে নিচে নাওয়াজ খান আর ওসমানের নানারকম কাজকর্মের শব্দ পাচ্ছিলাম। শুধু ভয় হচ্ছিল, ওদেরকে খুলে দেয়ার আগেই না চলে আসে। কিন্তু এল না। আমি প্রথমে সলীলের এবং পরে সলীল আর আমি মিলে জয়নালের বাধন খুলে দিলাম।
জয়নাল তার কজ্জিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, শুওরের বাচ্চাদের জান যদি আমি শেষ না করি!
আমি বললাম, আস্তে জয়নাল, আস্তে–
জয়নাল হিসহিস করে বলল, গলা ছিঁড়ে ফেলব আমি। কলজে টেনে বের করে ফেলব।
আমি আবার বললাম, আস্তে জয়নাল! আস্তে।
জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলব। জন্মের মত লুলা করে দেব।
মাথা গরম করিস না জয়নাল, খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। যখন ওরা ঢুকবে তখন তোরা মেঝেতে শুয়ে থাকিস মুখে টেপ লাগিয়ে, যেন বুঝতে না পারে তোদের হাত খোলা। তারপর যেই কাছে আসবে–
লাফিয়ে পড়ব! জয়নাল দাঁত কিড়মিড় করে বলল, গলা ছিঁড়ে ফেলব।
সলীল একটু ইতঃস্তত করে বলল, খালি হাতে? একটা লাঠিসোটা পেলে হত।
আমরা ঘরে খোজাখুজি করতে থাকি, লাঠি জাতীয় কিছু পাওয়া গেল না। পাশে একটা ছোট বাথরুম আছে, সেখানে কয়েকটা বোতল পাওয়া গেল। দড়ি দিয়ে সেগুলো। বেঁধে নেয়া হল। ঘুরিয়ে যদি ঠিকমত মারা যায় একজনকে ঘায়েল করতে কোন। অসুবিধা হওয়ার কথা না।
সলীল আবার বলল, একটা সিগন্যাল দিতে পারলে হত, ঠিক তখন লাফিয়ে পড়তাম!
আমি বললাম, এক কাজ করলে কি হয়?
কি কাজ?
বাথরুমে একটা লাইট সুইচ আছে।
হ্যাঁ। সলীল ঠিক বুঝতে পারল না, জিজ্ঞেস করল, লাইট সুইচ দিয়ে কি হবে?
যদি লাইট বাল্বটা খুলতে পারি তাহলে সেটার পিছনে একটা পয়সা দিয়ে বাল্বটা আবার লাগিয়ে দিতে পারি। তারপর যেই সুইচ অন করা হবে, ফিউজ কেটে পুরো বাসা অন্ধকার হয়ে যাবে। তারা একেবারে কিছু বুঝতে পারবে না –তোরা তখন অন্ধকারে লাফিয়ে উঠে —
সলীল হাতে কিল দিয়ে বলল, ভেরী গুড! বাথরুমের লাইট বাল্বটা খোলা খুব সহজ হল না। প্রথমে এক মুহূর্তের জন্যে জ্বালিয়ে দেখে নিলাম সেটা কোথায়, তারপর অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সেটা খুলে ফেললাম। তার জন্যে খুব সাবধানে বেসিনের উপর দাঁড়াতে হল। শুধু মনে হচ্ছিল
সবকিছু ভেঙে বুঝি হুড়মুড় করে নিচে পড়ব। বান্দ্রের পিছনে পয়সা দেয়ার পর বাটা আবার লাগাতে খুব কষ্ট হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা লাগিয়ে ফেললাম। আমাদের। প্রস্তুতি এখন শেষ।
সলীল আর জয়নাল তাদের মুখে সার্জিক্যাল টেপটা লাগয়ে নিয়ে হাত পিছনে করে শুয়ে রইল। দেখে মনে হয় তাদের হাত পিছমোড়া করে বাধা। তাদের হাতে দড়ির এক মাথা, অন্য মাথায় একটা বোতল। ঘুরিয়ে ঠিকমত মারলে সেটা রীতিমত একটা ভয়ংকর অস্ত্র। আমি বাথরুমে লাইটের সুইচটায় হাত দিয়ে বসে রইলাম। সুইচটা অন করতেই লাইট বাল্বের পিছনে রাখা পয়সাটা শর্ট সার্কিট করে মেইন সুইচে ফিউজ কেটে দেবে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে যাবে তখন ঘরটা।
আমরা তিনজন চুপচাপ অপেক্ষা করছি। বুকের ভিতরে এক ধরনের ধুকপুকুনি। সব কিছু ভালয় ভালয় কাজ করবে তো? সত্যি আমরা পালাতে পারব তো? এরা ভয়ংকর মানুষ, যদি পালাতে না পারি আমাদের জানে মেরে ফেলবে। যেভাইে হোক। আমাদের পালাতে হবে। যেভাবেই হোক।
ঠিক এই সময় আমার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। নাওয়াজ খান আর ওসমান কথা বলতে বলতে এসে ছিটকিনি খুলে ঘরে এসে ঢুকে বাতি জ্বালালো। আমি দরজার ফাঁক দিয়ে দেখছি, দুইজন মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে। ওসমান জিজ্ঞেস করল, প্রথমে কোনটাকে?