আমি ভিতরে যাই, তুই বাইরে থাক।
উঁহু! আমি মাথা নাড়লাম, জয়নাল তোকে চিনে না, গোলমাল করতে পারে। আমি যাই।
একটু ভেবে সলীল রাজি হল। বলল, ঠিক আছে, তুই যা। সাবধানে।
সলীল সেখানে দাঁড়িয়ে রইল, আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। ভারি একটা দরজা, তার মাঝে শক্ত লোহার ছিটকিনি লাগানো। আমি খুব সাবধানে কোন শব্দ না। করে সেই ছিটকিনি খোলার চেষ্টা করলাম, তবু খুট করে একটা শব্দ হয়ে গেল। আমি ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে গেলাম, কিন্তু কপাল ভাল, নাওয়াজ খান বা ওসমান ঘর থেকে বের হল না। আমি শেষ পর্যন্ত ছিটকিনিটা খুলতে পারলাম। খুব সাবধানে দরজা খুলে। ভিতরে ঢুকতেই জয়নাল ভয় পেয়ে হঠাৎ গোঁ গো শব্দ করে হাত পা ছুঁড়ে ছটফট করে উঠল।
আমি ছুটে জয়নালের কাছে গিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, চুপ জয়নাল! শব্দ করিস না। আমি মুনীর।
জয়নাল সাথে সাথে চুপ করে যায় কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমি শুনতে পেলাম পাশের ঘর থেকে ওসমান আর নাওয়াজ খান ছুটে বের হয়ে আসছে। বাইরে একটা আলো জ্বলে উঠল, সাথে সাথে সলীলের পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নাওয়াজ খান আর ওসমান ”ধর ধর” চিৎকার করে তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। আমি কি করব বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি বিছানার নিচে লুকিয়ে গেলাম।
সলীল পালিয়ে যেতে পেরেছে কিনা জানি না, দুই দুইজন বড় মানুষের সাথে কি সে দৌড়ে পারবে? পিছনের গেটটা খোলা থাকলে তবু একটা কথা ছিল। আমি প্রাণপণে খোদাকে ডাকতে থাকি–হে খোদা! সলীল যেন পালিয়ে যেতে পারে। তাকে যেন বদমাইশগুলি ধরতে না পারে। কিছুতেই যেন ধরতে না পারে–
একটু পরেই বুঝতে পারলাম, খোদা আমার দোয়া শুনেনি। আমি ওসমানের গলা শুনতে পেলাম, চাপা স্বরে বলছে, বদমাইশ ছেলে, এইবার আমি তোকে পেয়েছি, দেখ তোর আমি কি অবস্থা করি।
আমি সলীলের গলার স্বর শুনতে পারলাম, ছেড়ে দাও আমাকে, খবরদার।
প্রচণ্ড আংতকে আমার সারা শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে আসে। হে খোদা, এটা তুমি কি করলে? এখন কি হবে?
১৩. মুখোমুখি
সলীলকে ধরে নাওয়াজ খান আর ওসমান পাশের ঘরে নিয়ে গেল। সলীলকে কি করছে আমি জানি না কিন্তু শব্দ শুনে মনে হল দুই একটা ঘুষি কিল মেরে বসেছে। নাওয়াজ খান হঠাৎ বলল, ওসমান, থাম দেখি।
বদমাইশটাকে জানে মেরে ফেলব। আমার সাথে ফাজলেমি।
ঠিক আছে, যখন সময় হবে মেরো, এখন আমাকে একটু কথা বলতে দাও। এই ছেলে, তুমি এখানে এলে কেন?
সলীল কোন কথা বলল না।
তোমাকে আমি আগে দেখেছি। কয়দিন আগে এসেছিলে আমার সাথে দেখা করতে। সাথে আরেকজন ছিল তোমার। ওসমান বলেছে একটু আগে তুমি দরজায় ঢিল ছুঁড়েছ। এখন তুমি ভিতরে ঢুকেছ। ব্যাপারটা কি?
সলীল তখনো কোন কথা বলল না।
কথা বল ছেলে। না হলে তোমার খুব বড় বিপদ হতে পারে।
সলীল মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, কি বিপদ?
আমার মনে হয় না তুমি সেটা শুনতে চাও। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তুমি এখানে কেন এসেছ?
সলীল কোন কথা বলল না।
তুমি কি একা এসেছ না সাথে আর কেউ ছিল?
আমি একা।
তোমার সেই বন্ধু কোথায়?
বাইরে।
বাইরে কেন?
আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি যদি ভিতরে আটকা পড়ি, সে খবর দেবে।
কোথায় খবর দেবে?
আমি বলতে চাই না।
কেন বলতে চাও না?
সলীল কোন কথা বলল না।
নাওয়াজ খান ধমক দিয়ে বলল, সত্যি করে বল তোমার সেই বন্ধু কোথায়?
বাইরে। আমরা এত বোকা না যে দুইজন একসাথে দুকব। একজন ভিতরে, আরেকজন বাইরে।
হুম! নাওয়াজ খান অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ভিতরে ঢুকেছ কেমন করে?
বুদ্ধি খাঁটিয়ে। আমি যখন আপনার ড্রাইভারকে বাগানোর চেষ্টা করছিলাম তখন সে ঢুকে গেছে। তারপর দরজা খুলে দিয়েছে, তখন আমি ঢুকেছি। সে এখন বাইরে অপেক্ষা করছে।
আমার কি মনে হয় জান?
কি? সে ভিতরে কোথাও আছে। খুঁজলেই পাওয়া যাবে।
খুঁজেন তাহলে। সলীল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমরা এত বোকা না।
তোমরা বোকা না?
না।
তার মানে তোমরা অনেক কিছু জান?
সলীল চুপ করে রইল।
তোমরা জয়নালের কথা জান?
জানি।
কেমন করে জান? তার সাথে তো তোমাদের বন্ধুত্ব হওয়ার কথা না।
জয়নাল আমার বন্ধুর পাশের বাসায় কাজ করে। আমার বন্ধু তার চিঠিপত্র লিখে দেয়। সেই জন্যে তার সাথে পরিচয়।
তুমি জয়নালকে চেনো না?
না।
নাওয়াজ খান মনে হল একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি একটু আগে বলেছ যে তুমি বোকা না। আসলে সেটা সত্যি না। আসলে তুমি বোকা। অসম্ভব বোকা। মানুষ বোকা না হলে একজন মানুষ যাকে চিনে না তার জন্যে নিজের জীবন শেষ করে না। তুমি শেষ করেছ। জয়নালকে কেন এনেছি তুমি মনে হয় জান। সেটা যারা জানে তাদের নিয়ে আমি কোন ঝুঁকি নেই না।
আমার বন্ধু এতক্ষণে পুলিশের কাছে চলে গেছে। এক্ষুনি পুলিশ আসবে।
আমার মনে হয় তুমি মিথ্যা কথা বলছ। তোমাদের মাঝে কোন বড় মানুষ নেই। তোমরা ছোট বাচ্চারা অনেক বড় ব্যাপারে নাক গলিয়েছ। সেটার ফল তোমরা পাবে–
আমার বন্ধু–
তোমার কোন বন্ধু নেই। যদি থেকেও থাকে, তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিশেষ করে যদি আমার বিরুদ্ধে বলে। তাও এরকম উদ্ভট একটা গল্প। কিন্তু আমি তবু কোন ঝুঁকি নেব না। সত্যিই যদি তোমার বন্ধু পুলিশের কাছে যেয়ে থাকে, সত্যিই যদি পুলিশ তার কথা বিশ্বাস করে এখানে আসে, তার জন্যে একটু সময় দরকার। কম করে হলেও এক ঘণ্টা। আমি আধ ঘণ্টার মাঝে সব কাজ শেষ করে ফেলব।