সলীল ঢিলটা ছোঁড়ার আগেই ওসমান রেগে আগুন হয়ে গেটের দিকে ছুটে যেতে থাকে। আমি ঠিক এই সুযোগের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, খোলা দরজা দিয়ে হুট করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখি একটা ছোট টেবিল। টেবিলক্লথ দিয়ে ঢাকা। আমি দৌড়ে সেই টেবিলের নিচে লুকিয়ে গেলাম।
বাইরে কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। সলীল নিশ্চয়ই লাফিয়ে গেট থেকে নেমে যাবে, তাকে কখনোই ধরতে পারবে না। যতক্ষণ পারা যার ওসমানকে বাইরে ব্যস্ত রাখার কথা। মনে হয় সলীল সেটাই চেষ্টা করছে। সলীল কিছু একটা বলছে এবং ওসমান প্রচণ্ড গালি-গালাজ করছে শুনতে পেলাম। পরিকল্পনার প্রথম অংশটা মনে হয় ভালভাবেই কাজ করেছে।
আমি টেবিলের নিচে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি এর মাঝে একটু পরে শুনতে পেলাম ওসমান ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল, তারপর গজগজ করে কি একটা বলতে বলতে উপরে উঠে গেল। উপর থেকে ভারি গলায় নাওয়াজ খান জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে ওসমান?
আর বলবেন না স্যার! এক বদমাইশ ছেলে খামাখা গেটের উপরে বসে ঢিল ছুঁড়ছে!
হুমম। নাওয়াজ খান অবাক হয়ে বলল, কেন? ঢিল ছুঁড়ছে কেন?
বদমাইশী স্যার। পোলাপান যে কি বদমাইশ হয় আপনি জানেন না স্যার।
জানি। আমি জানি। কিন্তু এইটা কি বদমাইশী না অন্য কিছু?
অন্য কিছু কি?
নাওয়াজ খান ভারি গলায় বললেন, কোন কিছু সন্দেহ করছে না তো কেউ?
কি সন্দেহ করবে স্যার?
আমাদের কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের প্রজেক্ট?
আরে না স্যার! আপনি কি বলছেন! কোনদিনও না।
হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সাথে সাথে প্রচণ্ড আতংকে আমাদের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে। আমরা যেটা সন্দেহ করেছি সেটা সত্যি!
গরিব বাচ্চাদের নিয়ে নাওয়াজ খান কি করছে বুঝতে পারিনি, এখন বুঝতে পারলাম। তাদের মেরে শরীর থেকে কিডনিটা কেটে নেয়। অসুখ-বিসুখে মানুষের কিডনি নষ্ট হয়ে যায়, তখন অন্যের কিডনি লাগানো যায়। গরিব বাচ্চাদের কিডনি কেটে নিয়ে এরা বিক্রি করে। কি সর্বনাশা ব্যাপার! রশীদকে নিশ্চয়ই এভাবে মেরেছে। জয়নালকেও এভাবে মারবে। নাকি এর মাঝে মেরে ফেলেছে! এক ভয়ংকর ভয়ে আবার আমার সারা শরীর কেঁপে উঠে।
আমি খুব সাবধানে টেবিলের নিচে থেকে বের হয়ে পিছনের দরজাটি খুলে দিলাম। সলীলের একটু পরে ভিতরে এসে ঢোকার কথা। ভিতরে একজন না হয়ে দুজন হলে অনেক সুবিধে। আমি একবার ভাবলাম, যেটুকু জানবার জেনে গেছি, এখন বের হয়ে যাই, কিন্তু জয়নালের কথা মনে পড়ল। বেচারা কি অবস্থায় আছে না জেনে কেমন করে যাই? সলীলের জন্যে অপেক্ষা না করে আমি খুব সাবধানে নিচের তলাটি ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। অন্ধকার ঘর, খুব স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না, কিন্তু মনে হল দেখার মত বিশেষ কিছু নেই। সোফা, চেয়ার টেবিল, শেলফ এই ধরনের জিনিসপত্রই বেশি। জয়নালের কোন চিহ্ন নেই। তাকে মনে হয় দোতলাতে আটকে রেখেছে।
যখন শুনলাম উপরে দুইজন আবার কথা বলতে শুরু করেছে, আমি তখন খুব। সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। উপরে অনেকগুলি ঘর, যেই ঘরে নাওয়াজ খান ওসমানের সাথে কথা বলছে খুব সাবধানে সেই ঘরটা এড়িয়ে আমি অন্য ঘরগুলিতে উঁকি দিতে থাকি। প্রথম দুটি ঘরে অনেকগুলি বিছানা সাজানো, হাসপাতালে যেরকম। থাকে। তিন নম্বর ঘরটা অন্ধকার মনে হল। ভিতরে নানারকম ডাক্তারি যন্ত্রপাতি। চার নম্বর ঘরটার দরজা বন্ধ, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, ভিতরে আবছা অন্ধকার। মনে। হল একটা বিছানা কিন্তু বিছানাটি খালি, সেখানে কেউ নেই। আমি পরের ঘরটি দেখার জন্যে সরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হল মেঝেতে কেউ যেন শুয়ে আছে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি, সত্যি তাই। আবছা অন্ধকার, ভাল করে দেখা যায় না, কিন্তু মানুষটি। ছোট, নিশ্চয়ই জয়নাল হবে। মরে গেছে কিনা বুঝতে পারছিলাম না, তাই অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মনে হল এক সময় একটু নড়ে উঠল, তার মানে এখনো বেঁচে আছে। ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু মনে হল হাত দুটি পিছনে বাধা, মুখটিও কাপড় দিয়ে আটকানো, যেন কোন রকম শব্দ করতে না পারে। বেচারা জয়নাল! না জানি কতক্ষণ থেকে তাকে এভাবে বেঁধে ফেলে রেখেছে।
আমি সাবধানে উঠতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন কে যেন আমার ঘাড়ে হাত রাখল। আমি চমকে উঠলাম, ভয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠছিলাম, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে মাথা ঘুরিয়ে দেখি, সলীল। আমি বুকে হাত দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, সলীল তুই!
হ্যাঁ। সলীল গলা নামিয়ে বলল, জয়নালকে পেয়েছিস?
হ্যাঁ। ঐ দেখ।
সলীল জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে খানিকক্ষণ দেখে বলল, বেঁধে রেখেছে?
হ্যাঁ। মুখও বাঁধা।
কি সর্বনাশ! এখন কি করবি?
বাইরে গিয়ে খবর দিতে হবে। এরা বাচ্চাদের কিডনি, কেটে বিক্রি করে।
তুই কেমন করে জানিস?
আমি এদের কথা বলতে শুনেছি।
সর্বনাশ!
হ্যাঁ। চল যাই এখন।
আমাদের কথা যদি কেউ বিশ্বাস না করে?
আমার এই কথাটা আগে মনে হয়নি, সত্যি তো, আমরা বাইরে গিয়ে কাকে বলব? পুলিশকে? পুলিশ যদি আমাদের ধমক দিয়ে বের করে দেয় তখন? ততক্ষণে। যদি জয়নালকে মেরে ফেলে?
সলীল ফিসফিস করে বলল, জয়নালকে ছুটিয়ে নিতে হবে। তারপর এক সাথে তিনজন পালাব।
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম। জয়নালকে নিয়ে পালাতে হবে।