কি করা যায় বল তো?
সলীল খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের যেতে হবে তাকে বাঁচানোর জন্যে।
আমরা?
হ্যাঁ, কাউকে বলে লাভ নেই, কেউ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না।
ঠিকই বলেছিস। আমি মাথা নেড়ে বললাম, চল যাই তাহলে। দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ঠিক রওনা দেওয়ার আগে সলীল বলল, চল জারুল চৌধুরীকে একটা চিঠি লিখে যাই, কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি বলে। আমাদের যদি কিছু একটা হয় তাহলে অন্ততঃ কেউ একজন জানবে!
সলীল খুব সুন্দর বাংলা লিখতে পারে, খুব গুছিয়ে একটা চিঠি লিখে ফেলল। চিঠিটা তার দরজায় লাগিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম। বাইরে তখন অন্ধকার নেমে আসছে।
১২. গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক
আমার যখন গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি তখন টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার হয়ে এসেছে, রাস্তাঘাটে মানুষ বেশি নেই। আমরা দোতালা দালানটার দিকে তাকালাম, উপরে দুটি ঘরে বাতি জ্বলছে, এ ছাড়া পুরো ক্লিনিকটা অন্ধকার। সামনে বড় গেটটা বন্ধ, আমরা তবু সাবধানে একটু ধাক্কা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। হেঁটে হেঁটে আমরা ক্লিনিকের পিছনে গেলাম, সেটাও দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। পিছনেও একটা ছোট কাঠের গেট, সেই গেটটাও বন্ধ। আমরা দেওয়ালের উপর দিয়ে ভিতরে তাকালাম। কোন মানুষজন নেই, দেখে মনে হয় এখানে কোন মানুষজন থাকে না। আমি গলা নামিয়ে বললাম, ভিতরে ঢুকতে হবে আমাদের।
কেমন করে ঢুকবি?
দেওয়াল টপকে।
যদি ধরা পড়ে যাই?
কার কাছে ধরা পড়বি? কাউকে তো দেখি না।
তা ঠিক।
এদিক সেদিক তাকিয়ে আমার দুইজন সাবধানে দেওয়াল বেয়ে উঠে ভিতরে লাফিয়ে পড়লাম। তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে গিয়ে পেটের খানিকটা ছাল উঠে গেল কিন্তু এখন সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। চোর যখন কোথাও চুরি করতে আসে, প্রথমেই নাকি পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাটা ঠিক করে নেয়। আমরাও আজকে চোরের মতই ঢুকেছি, পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা ঠিক করতে গিয়ে দেখি, কাঠের ছোট গেটটাতে একটা ছোট তালা লাগানো। দৌড়ে যদি পালাতে হয় কাজটা খুব সহজ হবে না। আপাততঃ চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম, এখন খামাখা এটা নিয়ে চিন্তা করে কি লাভ?
আমরা খুব সাবধানে গুঁড়ি মেরে দোতলা বাসাটার কাছে এলাম। পেছনে একটা দরজা, আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দেখি ভিতর থেকে বন্ধ। সামনেও একটা দরজা, সেটাও নিশ্চয়ই বন্ধ। আমরা তবু সাবধানে পরীক্ষা করে দেখলাম। আমরা উপরের দিকে তাকালাম, উপরে কয়েকটা জানালা রয়েছে কিন্তু প্রত্যেকটা জানালাতেই লোহার শিক লাগানো। পানির পাইপ বেয়ে একটা কার্নিশে ওঠা যায় কিন্তু সেখান থেকে অন্য কোথাও যাবার সহজ কোন উপায় নেই। আমরা দুজন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি থেকে নিজেদের বাচিয়ে নানা রকম পরিকল্পনা করতে থাকি। অনেক ভেবে চিন্তে যে পরিকল্পনাটা দাঁড়া করালাম সেটা ভয়ংকর বিপজ্জনক, কিন্তু মনে হল এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। দুজনে মিলে পরিকল্পনাটা বেশ কয়েকবার যাচাই করে দেখলাম। যদি কোন গোলমাল হয়ে যায় তখন কি করতে হবে সেটাও মোটামুটি ঠিক করে নেয়া হল। পরিকল্পনায় একজন দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করাবে, অন্যজন গোপনে ভিতরে ঢুকে যাবে। যে দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করবে তার ছোটাছুটি করতে হবে বলে সেটা সলীলকে দেয়া হল। শিং মাছের ঘাই খেয়ে এখনো বুড়ো আঙুলটা টন টন করছে, যদি টানা হ্যাঁচড়া করে দেওয়াল বেয়ে উঠতে হয়, সলীল সেটা আমার থেকে ভাল করতে পারবে।
আমি দরজার কাছাকাছি একটা ঝোঁপের নিচে লুকিয়ে গেলাম। সলীল বড় বড় কয়টা ঢেলা নিয়ে কাঠের গেটটার উপরে পা ঝুলিয়ে বসে, একটা দরজায় ছুঁড়ে মারল। বেশ শব্দ করেই। সাথে সাথে ভিতর থেকে নাওয়াজ খানের ড্রাইভারের গলা শুনতে পেলাম, চিৎকার দিয়ে বলল, কে?
সলীল গেটের উপরে বসে বলল, আমি।
আমি কে? ‘
সলীল উত্তর না দিয়ে আরেকটা ঢিল ছুঁড়ে মারল দরজায়।
ওসমান সাথে সাথে দরজা খুলে মাথা বের করে ধমক দিয়ে বলল, কে দরজায় শব্দ করছে? কে?
বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে, তার উপর টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সলীল যে। গেটের উপরে বাস আছে ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। সে গেটের উপর থেকে চিৎকার করে বলল, আমি! এই যে আমি! এইখানে।
ওসমান যতটুকু রেগে উঠল মনে হল তার থেকেও বেশি অবাক হল। দরজা খুলে বাইরে এসে বলল, পাজী ছেলে! দরজায় ঢিল ছুঁড়ছ কেন?
সলীল গেটের উপর থেকে বলল, হাতের ব্যায়াম করছি। ঢিল ছোঁড়া হাতের খুব ভাল ব্যায়াম, জানেন তো।
কি বললি? কি বলছিস তুই বদমাইশ?
তুই তোকারি করছেন কেন? আমি কি আপনার চাদীতে ঢিল মেরেছি? হ্যাঁ? ওসমান কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ভাগ এখান থেকে। ভাগ।
সলীল একটা ঢিল হাতে নিয়ে বলল, আপনার কি মনে হয়, এখান থেকে ঢিল ছুঁড়ে কি দোতলার জানালার কাঁচটা ভাঙতে পারব?
কি? কি বললি?
মনে হয় পারব। এই দেখেন-ওসমান কিছু বলার আগেই জানালার দিকে একটা বড় ঢিল ছুঁড়ে দেয়। অল্পের জন্যে সেটা কাঁচে না লেগে কার্নিশে লেগে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
ওসমান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সলীল তখন আরেকটা ঢিল হাতে নিয়েছে, সেটা জানালার দিকে নিশানা করে বলল, এইটা নিশ্চয়ই পারব! ওয়ান টু–