আমি তাকিয়ে দেখি, বাবা। বাবার হাতে একটা বন্দুক। বাবা বন্দুকটা আমার দিকে তাক করে ধরে আবার ডাকলেন, মুনীর!
আমি ভয় পেয়ে ছুটতে শুরু করলাম, তখন বাবাও আমার পিছনে পিছনে ছুটতে লাগলেন। কিন্তু আমি যেরকম পানির উপর দিয়ে দৌড়াতে পারি, বাবা পারেন না। পানিতে পা দিতেই বাবা ডুবে গেলেন আর সবগুলি অক্টোপাস এসে বাবাকে প্যাচিয়ে ধরল। বাবা তখন চিৎকার করতে লাগলেন, মুনীর মুনীর মুনীর।
আর ঠিক তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনি সত্যিই কে যেন আমাকে ডাকছে, মুনীর, এই মুনীর।
আমি চোখ খুলে দেখি সলীল। আমার মুখের উপর উবু হয়ে বসে আছে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম, বললাম, সলীল! তুই?
সলীল দাঁত বের করে হেসে বলল, আমি ঠিক ভেবেছি তুই এখানে থাকবি! ঠিক ভেবেছি।
আমার তখনো চোখে ঘুমের ঘোর, চোখ কচলে বললাম, কেমন করে বুঝলি?
না বোঝার কি আছে? সলীল হাতে কিল দিয়ে বলল, তুই যদি বাড়ি থেকে পালাস তাহলে আর কোথায় যাবি?
আমি বাড়ি থেকে পালাইনি, বাবা বের করে দিয়েছে।
ঐ একই কথা!
মোটেও এক কথা না। বাবাকে তুই চিনিস না। আরেকটু হলে বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে ফেলত।
সলীল কিছু বলল না, আমিও আর সেটা নিয়ে কিছু বললাম না। সলীলকে দেখে এত ভাল লাগছে যে, বলার নয়। ইচ্ছে হচ্ছিল একেবারে জড়িয়ে ধরি কিন্তু হাজার হলেও বড় হয়ে যাচ্ছি, কাজেই আর জড়িয়ে ধরলাম না, কিন্তু মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, সলীল হবে আমার সারা জীবনের প্রাণের বন্ধু। যেরকম বন্ধুর জন্যে মানুষ জান দিয়ে দেয় সেরকম বন্ধু।
সলীলের হাতে একটা ঠোঙা, আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা।
কি?
তোর জন্যে পরটা মাংস এনেছি!
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, সত্যি? খোদার কসম?
ধুর গাধা, এইজন্যে আবার খোদার কসম বলতে হয়?
আমি তাড়াতাড়ি ঠোঙাটা খুলে দেখি সত্যিই খবরের কাগজে মোড়া বড় বড় দুইটা পরটা ভিতরে মাংস দিয়ে প্যাচিয়ে এনেছে। আরেকটা ছোট ঠোঙায় দুইটা লাড়ু। সাথে বড় বড় দুইটা কলা। খাবারগুলি দেখে আমার একেবারে জিবে পানি এসে গেল।
সলীল বলল, আমি বুঝেছিলাম তোর নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি। সুবলের রেস্টুরেন্ট থেকে কিনে এনেছি। দ্যাখ খেয়ে, মনে হয় এখনো গরম আছে।
কেন জানি হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে গেল। খুব সাবধানে আমি চোখের পানি মুছে ফেললাম। সলীল না দেখার ভান করে দূরে তাকিয়ে রইল।
আমি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, তুই কেমন করে খবর পেলি?
এরকম খবর কি চাপা থাকে নাকি? তুই রাগ করে বাসা থেকে পালিয়ে গেছিস, লোকজন সেটা জানবে না? আমি গিয়েছিলাম তোদের বাসায়।
সত্যি? গিয়েছিল?
হ্যাঁ।
কি দেখলি?
মাসীমা খুব কান্নাকাটি করছেন।
আর লাবলু? জ্বর কমেছে?
জ্বর ছিল নাকি? দেখে তো মনে হল না। লাবলু কাঁদছে না তবে খুব গম্ভীর।
আমি বাবার কথা জিজ্ঞেস করলাম না, সলীল নিজেই বলল, তোর বাবা খালি লাফ ঝাঁপ দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
তাই?
হ্যাঁ। বলছেন দুইদিন যখন না খেয়ে থাকবি তারপরেই নাকি সুড়সুড় করে ফেরৎ যাবি।
তাই বলছেন?
হ্যাঁ। সলীল মাথা নাড়ল, তুই যখন ফিরে যাবি তখন নাকি তোকে আচ্ছামত ধোলাই দেওয়া হবে।
আমি আর কিছু বললাম না।
সলীলের সাথে আরো নানারকম কথা হল, আমি তাকে শিং মাছের ঘাই খাওয়ার কথা বললাম, তার বিচিত্র চিকিৎসার কথা শুনে সে হেসেই বাচে না। জারুল চৌধুরী। কোথায় যেতে পারেন সেটা নিয়েও কথা হল। রাত্রে কেমন ঘুম হয়েছে, একা একা ভয়। পেয়েছি কিনা সলীল সেগুলিও খুব খুটিয়ে খুটিয়ে জানতে চাইল। সন্ধ্যে হয়ে এলে যখন সলীলের বাসায় চলে যাবার সময় হল, হঠাৎ করে সে বলল, তোদের বাসার কাছে আরো একজন পালিয়ে গেছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কে?
তোদের বাড়িওয়ালা উকিল সাহেবের বাসায় গরু রাখে যে ছেলেটা—
জয়নাল?
হ্যাঁ, জয়নাল।
জয়নালের কি হয়েছে?
বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। গরু বাছুর ছেড়ে দিয়েছে, সেই গরু বাছুর নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে, জয়নালের দেখা নেই।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হতেই পারে না।
হতে পারে। সলীল হাসার মত ভঙ্গি করে বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি। তোদের উকিল সাহেব এই এত বড় একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জয়নালকে ধরে আনা হলেই এক ঘা মেরে মাথা দুইভাগ করে দেবেন।
আমি অবাক হয়ে বসে রইলাম। মাত্র সেদিন আমি জয়নালের চিঠি লিখে দিয়েছি। লম্বা চিঠি। সেখানে কাজ ছেড়ে দেওয়ার কোন উল্লেখ নেই। হঠাৎ করে আমার একটা কথা মনে হল। আমি চমকে উঠে বললাম, সর্বনাশ!
সলীল অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে?
নাওয়াজ খান!
নাওয়াজ খান কি?
নাওয়াজ খান নিশ্চয়ই জয়নালকে আটকে রেখেছে! নিশ্চয়ই খুন করে ফেলবে।
কি বলিস তুই?
হ্যাঁ। তার আরেক বন্ধু ছিল যে নাওয়াজ খানের কাছে যেতো, কয়দিন আগে খুন হয়েছে, মনে নেই?
হ্যাঁ, তুই বলেছিলি।
আরো অন্যেরা নিখোঁজ হয়ে গেছে, কোন খোঁজ নেই। এখন জয়নালের কোন খোঁজ নেই! তুই বুঝতে পারছিস না?
সলীল ভুরু কুঁচকে বলল, তুই বলছিস জয়নাল খুন হয়ে গেছে?
আল্লাহ না করুক! কিন্তু—
কিন্তু কি?
জয়নালকে আমি চিনি, সবকিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে সে কোনদিন বাসা থেকে পালাবে না। নিশ্চয়ই তার কোন বিপদ হয়েছে। নিশ্চয়ই–
সলীল মুখ সূচালো করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই ঠিকই বলেছিস। নাওয়াজ খান খুব ডেঞ্জারাস মানুষ।