আমি কয়েক মুঠি চিড়া খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে গেলাম। ভিতরে কি চমৎকার কুসুম কুসুম গরম! আরামে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল। আমি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটা নিভিয়ে দিলাম। সাথে সাথে গাঢ় অন্ধকারে চারিদিক ঢেকে গেল।
জায়গাটা কি আশ্চর্য নির্জন সুমসাম। হঠাৎ হঠাৎ রাতের পাখি ডেকে উঠে, ডানা ঝাঁপটায়। মাঝে মাঝে নিশাচর কোন একটা প্রাণী ছুটে যায়, কে জানে কি রকম প্রাণী। এ ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই।
আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। আমার বাবার কথা মনে পড়ে, মায়ের কথা মনে পড়ে, লাবলুর কথা মনে পড়ে। কে জানে লাবলুর জ্বরটা কমেছে কিনা। শুয়ে শুয়ে আমার। মনে হতে থাকে কোন দিন বুঝি ঘুম আসবে না। কিন্তু একসময় সত্যি সত্যি আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
রাতে খুব ভাল ঘুম হল না, হবে আমি সে রকম আশাও করিনি। একটু পরে পরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল আর আমি চমকে চমকে উঠছিলাম। শেষরাতের দিকে অবিশ্যি আমি বেশ ভালভাবেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। প্রথমে বুঝতে পারলাম না আমি কোথায়, হঠাৎ করে আমার সব কথা মনে পড়ল আর মনটা এত খারাপ হল যে, বলার নয়। আমি উঠে বসে জানালাটা খুলে বাইরে তাকালাম, আবছা আলো হয়ে। আছে। কি সুন্দর লাগছে চারিদিকে! আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভোরবেলা খুব চমৎকার একটা ব্যাপার। মানুষের মন এমনিতেই তখন ভাল হয়ে যায়। পৃথিবীতে এত। যে খারাপ মানুষ আছে আর এত যে খুনখারাপী, চুরি ডাকাতি হয়, আমি একেবারে বাজি ধরে বলতে পারি এরকম ভোরবেলায় কখনো কোথাও কোন খারাপ কাজ হয় না। কিছুক্ষণের জন্যে পৃথিবীর সব মানুষ ভাল হয়ে যায়।
একটু বেলা হলে আমি জারুল চৌধুরীর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখি তাঁর দরজায় এই এত বড় একটা তালা ঝুলছে। জারুল চৌধুরী এমনিতে নিজের দরজায় কোন তালা লাগান না, নিশ্চয়ই কয়েকদিনের জন্যে অন্য কোথাও গেছে। আমার একটু মন খারাপ হল, কারো সাথে কথা বলার জন্যে আমার বুকটা একেবারে হাঁশফাশ করছে।
জারুল চৌধুরীকে না দেখে আমি ভাবলাম সলীলের বাসায় যাই, কিন্তু আজ স্কুল খোলা, সে নিশ্চয়ই স্কুলে যাবে। আমার বইপত্র খাতা কলম কিছু নেই, স্কুলে যাবার। কোন প্রশ্নই আসে না। কি করব বুঝতে না পেরে আমি হাঁটতে বের হলাম। আমি সবসময়ই গ্রামের বেশ কাছাকাছি থেকেছি কিন্তু গ্রামটা কখনোই খুব ভাল করে দেখা হয়নি। আজকে হয়তো একটু ঘুরে ঘুরে দেখতে পারব।
হাঁটতে হাঁটতে আমি বেশ কিছু জিনিস আবিষ্কার করলাম। গ্রামে অনেক বাচ্চা আছে যারা কখনোই স্কুলে যায় না। স্কুলে না গিয়ে তারা যে খেলাধুলা করে বেড়াচ্ছে সেটা সত্যি নয়। সবাই কোন না কাজ করছে। অনেকে গরু মাঠে নিয়ে যাচ্ছে, অনেকে ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছে, অনেকে ঘাস কাটছে, আবার অনেকে মাছ ধরছে। নদীর ধারে একটা ডোবার পাশে অনেকগুলি বাচ্চা মিলে মাছ ধরছিল। প্রথমে কাদামাটি দিয়ে একটা ছোট অংশ আলাদা করে গামলা দিয়ে পানি সেঁচতে শুরু করল। পানি যখন কমে এল তখন দেখি অনেক রকম মাছ সেখানে কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। বাচ্চাগুলি হাতড়ে হাতড়ে সেগুলি ধরতে লাগল। আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম দেখে একজন বলল, মাছ ধরতে চাও?
আমি মাথা নাড়তেই সে বলল, আস তাহলে ধর!
আমি শার্টের হাতা গুটিয়ে মাছ ধরতে শুরু করলাম। ব্যাপারটা দেখতে যত সহজ মনে হয় আসলে মোটেও তত সহজ নয়। হাত থেকে পিছলে পিছলে বের হয়ে যায়। আমার মাছ ধরা দেখে বাচ্চাগুলি হেসেই বাঁচে না। মাছ ধরার মাঝে যে কোন বিপদ থাকতে পারে আমার একবারও মনে হয়নি, কিন্তু হঠাৎ একটা শিং মাছ বুড়ো আঙুলে ঘঁই মেরে বসল। আমি চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালাম। একজন জিজ্ঞেস করল, শিং মাছ। মেরেছে?
আমি মাথা নাড়লাম, বুড়ো আঙুল থেকে রক্ত বের হয়ে গেছে। ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, শিং মাছ বড় খচ্চর, ঠিক করে ধরতে হয় উপর থেকে চেপে, না হলে ঘাই মেরে দেয়। অনেক ব্যথা করবে এখন।
সত্যি সত্যি অনেক ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ছোট মতন একটা বাচ্চা বলল, আঙুলের মাঝে পেশাব কর, ব্যথা কমবে।
আমি প্রথমে ভাবলাম ছেলেটা আমার সাথে ফাজলেমি করছে, কিন্তু দেখলাম অন্য সবাই মাথা নাড়ল, ফাজলেমি নয়, এটা চিকিৎসা। এরকম চিকিৎসায় আমার বেশি ভরসা নেই, আমি হাত ধুয়ে উঠে এলাম। যখন চলে আসছিলাম একজন বলল, তোমার মাছগুলি নিয়ে যাও।
আমি বললাম, আমার লাগবে না! তোমরা নিয়ে নাও।
দেখতে দেখতে আঙুলটা ফুলে উঠল। আমি হেঁটে হেঁটে ফিরে এলাম। জারুল চৌধুরী এখনো ফিরে আসেননি। আমি খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে আবার গাছঘরে ফিরে গেলাম। মনটা এত খারাপ হয়ে আছে যে, বলার নয়। খুব খিদে পেয়েছে কিন্তু শুকনো চিড়া চিবিয়ে খাওয়ার ইচ্ছে করল না। আমি গাছঘরের মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলাম। পেটে খিদে, হাতে ব্যথা। মনটা খুব খারাপ। কেন জানি শুধু লাবলুর। কথা মনে হচ্ছে। আমি শুয়ে শুয়ে খানিকক্ষণ কাদলাম, তারপর মনে হয় একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি খুব বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখলাম। আমি একটা নদীর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। নদীর পানি কুচকুচে কাল। সেই পানির নিচে লম্বা লম্বা শুড়ের। অক্টোপাস। সেগুলি আমাকে ধরতে আসছে আর আমি তার মাঝে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ আমাকে কে যেন ডাকল, মুনীর!