আমি সোজাসুজি বাবার চোখের দিকে তাকালাম, আর কি আশ্চর্য! বাবা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না, চোখ সরিয়ে নিলেন। সেইভাবে চিৎকার করে বললেন, বের হয়ে যা–এই মুহূর্তে বের হয়ে যা —
আমি আর কোন কথা বললাম না। ঠিক সেইভাবে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মা চিৎকার করে কি যেন বলছেন, লাবলুটা কাঁদছে কিন্তু কিছুই আমার কানে আসছিল না। কিছুই না।
১১. একা একা
আমি রাস্তা ধরে হাঁটছি। ভাগ্যিস অন্ধকার হয়ে গেছে, তাই আমি যে হু হু করে কাঁদছি সেটা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। প্রথম ঘণ্টাখানেক আমি কোথায় কোথায় হেঁটেছি নিজেও জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল –বেঁচে থেকে কি হবে? মরে যাই না কেন? এক-দুই বার যখন রাস্তা দিয়ে একটা ট্রাক বা বাস গিয়েছে, মনে হচ্ছিল, লাফিয়ে পড়ে যাই সেগুলির। সামনে। ঘণ্টাখানেক পর আমার মন একটু শান্ত হল। আমি তখন স্কুলের দেয়ালে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। যেখানে বসেছি জায়গাটা একটু অন্ধকার, লোকজন আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না। একজন দুইজন হঠাৎ হঠাৎ দেখে একটু অবাক হয়ে তাকিয়েছিল কিন্তু আমি গা করলাম না। কোন কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না।
বাবা আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছেন, আমি আর কোনদিন বাসায় ফিরে যাব না। পৃথিবীতে কত বাচ্চাই তো আছে যাদের বাবা নেই, মা নেই, একা একা জীবন কাটিয়ে দেয়। আমি সেভাবে জীবন কাটিয়ে দেব। জুতা পালিশ করে ফেরিওয়ালা হয়ে মিন্তির কাজ করে কোন না কোনভাবে বেঁচে থাকব। সবাই যে পড়ালেখা করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে সেটা তো সত্যি নয়। কাউকে কাউকে কুলি মজুর, রিকশাওয়ালা তো হতে হবে। তাই হব আমি। ট্রেনে করে চলে যাব যতদূর যাওয়া যায়। দূরে কোন শহরে, অজানা কোন গ্রামে। অসুখ-বিসুখ হয়ে মরে গেলে তো ভালই। চুপচাপ কোন গাছের নিচে শুয়ে মরে যাব আমি। আমার কথা আর কে ভাববে! গভীর দুঃখে আমার চোখে। পানি এসে গেল হঠাৎ।
আরো যখন রাত হল তখন হঠাৎ করে মশা কামড়াতে শুরু করল। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করছিলাম, প্রথমে ভাবলাম, রেল স্টেশনে গিয়ে শুয়ে থাকি। কত গরিব মানুষ শুয়ে থাকে ঠাণ্ডা মেঝেতে, আর একজন বেশি হলে ক্ষতি কি?
ঠিক তখন আমার জারুল চৌধুরীর গাছঘরের কথা মনে পড়ল! কি আশ্চর্য, সবচেয়ে প্রথমেই তো আমার গাছঘরের কথা মনে পড়ার কথা ছিল। রাগে দুঃখে অভিমানে মাথাটা গরম হয়ে আছে বলে এতক্ষণ মনে পড়েনি। হঠাৎ করে আমি আমার বুকের ভিতর কেমন জানি একটা বল অনুভব করতে থাকি। আমি যতদিন ইচ্ছা গাছঘরে থাকতে পারি। আমার আর ভয় কি?
রাত তখন কয়টা বাজে আমি জানি না। আমি সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামালাম না। তখন তখনই স্কুলের দেয়াল থেকে নেমে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অনেকটুকু রাস্তা, সলীলের সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে গেছি বলে আগে কখনো টের পাইনি। দিনের বেলা রাস্তাটা কত পরিচিত মনে হয়, এখন রাত্রিবেলা সবকিছু কেমন বিচিত্র মনে। হচ্ছে। গাছগুলিকে মনে হয় মানুষ, ঝোঁপগুলিকে মনে হয় কোন ধরনের জন্তু জানোয়ার, আর হঠাৎ হঠাৎ করে যখন রাস্তার পাশে থেকে কুকুর বিড়াল কিছু একটা বের হয়ে আসে, আমি এত জোরে চমকে উঠি যে, সেটা আর বলার মত নয়! অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে আমার কত কি মনে হয়! কেমন জানি এক ধরনের অভিমান হতে থাকে। কার উপরে অভিমান কে জানে! চোখে পানি এসে যায় একটু পরে পরে।
জারুল চৌধুরীর বাসায় গিয়ে দেখি পুরোটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। কে জানে বাসায় নেই নাকি ঘুমিয়ে গেছেন। কত রাত হয়েছে জানি না, কিন্তু জারুল চৌধুরী বলেছেন। তিনি নাকি অনেক রাত জেগে বই পড়েন। হয়তো বাসায় নেই, ঢাকা চলে গেছেন। এই অন্ধকারে বিজন বনে আমি একা চিন্তা করেই আমার কেমন জানি ভয় ভয় করতে থাকে।
আমি অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে গাছঘরের নিচে এসে সাবধানে গাছের ফোকড়ে হাত দিতেই সত্যি সত্যি ছোট একটা প্লাস্টিকের কৌটা পেলাম। এর মাঝে গাছঘরের চাবিটা। সেটা হাতে নিয়ে আমি হাতড়ে হাতড়ে ঝুলে থাকা দড়িটা বের করে একটা হ্যাঁচকা টান দিলাম, সাথে সাথে উপর থেকে দড়ির মইটা ঝপাং করে এসে নিচে পড়ল। জারুল চৌধুরী গাছঘর নিয়ে যা যা বলেছিলেন সত্যি সত্যি তাই করেছেন! আমি সাবধানে মই বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। অন্ধকারে চাবি দিয়ে দরজায় লাগানো তালাটা খুলতে বেশ কষ্ট হল, শেষ পর্যন্ত সেটা খুলে আমি মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকলাম। বাম পাশে তাকের মাঝে একটা ম্যাচ আর মোমবাতি থাকার কথা। সত্যি সত্যি সেটা পেয়ে গেলাম। মোমবাতিটা জ্বালাতেই ভিতরে কেমন জানি এক ধরনের স্বস্তি আর নিরাপদের ভাব চলে এল। আমি মইটা টেনে তুলে দরজাটা বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়লাম।
গাছের উপর ছোট পুতুলের ঘরের মত একটা ঘর, তার মাঝে গভীর রাতে আমি একা একা বসে আছি। পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার কি বিচিত্র লাগতে থাকে! আমি গাছঘরের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে তাকালাম। ছোট ছোট তাক, তার মাঝে বইপত্র কাগজ কলম। ছোট ছোট টিন, খুলে দেখি সেগুলিতে চিড়া মুড়ি আর গুড়। একটা পানির বোতল, কবেকার পানি কে জানে। দেয়ালে একটা টর্চলাইট, একটা চাকু আর একটা দড়ি ঝুলছে। ঘরের এক কোণায় ছোট একটা তোষকের মত জিনিস গুটানো, এটা নিশ্চয়ই স্লিপিং ব্যাগ হবে। আমি স্লিপিং ব্যাগটা খুলে ফেললাম। সত্যিই চমৎকার একটা বিছানা, ভিতরে ঢুকে গেলে একই সাথে তোষক এবং লেপ হয়ে যায়! বালিশ নেই, কিন্তু বালিশ না হলে আর ক্ষতি কি? কোথায় জানি পড়েছিলাম বালিশ ছাড়া ঘুমানো নাকি স্বাস্থ্যকর!