এখুনি তো মারবে।
আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। লাবলুটার মত গাধা আর একটাও নেই। আজকালকার দুনিয়ায় এরকম বোকা মানুষ কেমন করে জন্ম নেয় কে জানে! আমি গলা নামিয়ে বললাম, শার্টের তলায় একটা হাফ সোয়েটার পরে নে। আর মনে রাখিস, যখন মারবে তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করবি। ভান করবি মরে যাচ্ছিস।
কেন?
তাহলে ব্যথা কম লাগে।
লাবলু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমার বয়স বার, লাবলুর আট, আমার থেকে চার বছরের মত ছোট। কিন্তু তার বুদ্ধিশুদ্ধি মনে হয় একেবারে তিন বছরের বাচ্চার। আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আর খুব জোরে যদি চিৎকার করিস তাহলে কেউ . একজন এসে তো ছুটিয়েও নিতে পারে।
কে ছুটাবে?
আমি কিছু বললাম না। সত্যিই তো, কে ছুটাবে? মায়ের সেই সাহস নেই, ইচ্ছাও নেই। আশেপাশের বাসায় যারা আছে তারা শুধু মজা দেখে। আমি কেনে আঙুল দিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া মনে হয় আর কোন গতি নেই। লাবলুটার কি অবস্থা হবে সেটাই চিন্তা। মাঝে মাঝে বাবা মায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের ত্যাজ্যপুত্র করে দেয়, ত্যাজ্যবাবা করে দেওয়ার কি কোন নিয়ম নেই?
.
রাত্রে খাবার পর বাবা আমাকে আর লাবলুকে পিটালেন। সাধারণতঃ তাই করেন, খেয়ে মনে হয় আগে একটু জোর করে নেন। তারপর আমাদের বলেন বই নিয়ে আসতে। আমরা বই নিয়ে এসে বসি, তারপর আমাদের ইংরেজি বানান জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন। একটার পর আরেকটা, যতক্ষণ না আটকে যাই। আমাকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, “লেফটেনেন্ট”, সেটা জানতাম। ঠিক ঠিক বলামাত্র বাবার মুখ রাগে কালো হয়ে গেল। তখন জিজ্ঞেস করলেন ”নিমোনিয়া, সেটাও ঠিক ঠিক বলে ফেললাম। তখন বাবা আরও রেগে গেলেন, দাঁত কিড়মিড় করে জিজ্ঞেস করলেন ”ইউক্যালিপ্টাস”, আমি আটকে গেলাম। সাথে সাথে বাবার চোখগুলো জ্বলে উঠল একশ ওয়াটের বাতির মত। মুখে লোল টেনে বললেন, শয়তানের বাচ্চা, বদমাইশের ধাড়ী, পড়াশোনা নেই, নামাজ রোজা নেই, দিনরাত শুধু ঘোরাঘুরি, আজকে যদি আমি তোর জান শেষ না করি।
শিউলী গাছের ডালটা আগেই ভেঙে এনেছিলেন, সেটা আমার উপর দিয়ে গেল। আমি গরুর মত চিৎকার করতে করতে একটা ভীড় জমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কোন লাভ হল না। আশেপাশে যারা থাকে তারা জানালা খুলে মজা দেখতে লাগল। লাবলুটাকে এত ট্রেনিং দেয়ার পরও কোন লাভ হল না। মাথা নিচু করে ফোঁসফোঁস করে কঁদতে কাঁদতে মার খেয়ে গেল। চিৎকার করে না বলে বাবা ঠিক বুঝতে পারেন মারটা ঠিকমত লাগছে কি না, বাবা মনে হয় তাই গাধাটাকে আরো জোরে জোরে মারেন।
আমাদের পেটানোর পর বাবার এক রকমের আরাম হয়। খানিকক্ষণ তখন হাসি হাসি মুখ করে মায়ের সাথে সাংসারিক কথাবার্তা বলেন। তারপর বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যান। আজকেও বের হয়ে গেলেন। কোথায় যান কাউকে বলে যান না, কিন্তু আমরা সবাই জানি। বাবার বাজারের ব্যাগ বোঝাই করা থাকে ওষুধ। যেখানে কাজ করেন সেখান থেকে চুরি করে আনেন। বাবা এই ওষুধগুলি বিক্রি করতে যান। মীনা ফার্মেসীর মতি মিয়ার সাথে ঠিক করে রাখা আছে, বাবা ওযুধগুলি তাদের কাছে কম দামে বিক্রি করে আসেন।
বাবা ফিরে আসার আগেই আমি আর লাবলু শুয়ে পড়ি। শুয়ে শুয়ে শুনি বাবা ঘরে ঢুকছেন। ঘুমানোর আগে বাবা চা খান। চা খেয়ে ওজু করেন, আবার অনেকক্ষণ। সময় নিয়ে বিকট শব্দ করতে করতে জিব পরিস্কার করেন। তারপর এশার নামাজ। পড়েন। আমি আর লাবলু শুয়ে শুয়ে শুনি বাবা সুর করে করে সূরা পড়ছেন। বাবা কখনো নামাজ কাজা করেন না। মনে হয় অনেক রকম চুরিচামারি করেন, সেই সব পাপ কাটানোর জন্যে তাকে অনেক নামাজ পড়তে হয়।
লাবলু বিছানায় শুয়ে ফোঁসফোঁস করে কাঁদে। আমি তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিই। চাপা গলায় আদর করে, কিছু একটা বলে মনটা ভাল করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোন লাভ হয় না। এই গাধাটা কাঁদতেই থাকে। যদি কোনদিন বাসা থেকে পালাই মনে হয় লাবলুটাকে নিয়েই পলাতে হবে। কি যন্ত্রণা!
০২. সলীল
আমাদের ক্লাসে তিন রকমের ছেলে রয়েছে। এক রকমের ছেলে হচ্ছে ভাল ছেলে। তারা মন দিয়ে পড়াশোনা করে, তাদের চুল নিখুঁতভাবে আচড়ানো থাকে। তাদের জামা কাপড় হয় ধবধবে পরিষ্কার, তারা কখনও হোম ওয়ার্ক আনতে ভুলে না, তাদের হোম ওয়ার্কে কখনো কোন ভূল থাকে না। তারা কখনো খারাপ কথা বলে না, মারপিট করে, রাস্তা থেকে আচার কিনে খায় না। তাদের বাবারা সাধারণতঃ সাবজজ, না হয় ম্যাজিস্ট্রেট, না হয় জেলর। তাদের সাথে মারপিট করলে তাদের বাবারা হেডমাস্টারের কাছে দারোয়ান দিয়ে কড়া চিঠি লিখে পাঠান। তারা সবাই বড় লোকের ছেলে, সেজন্য তাদের চেহারা ছবিও ভাল।
আরেক ধরনের ছেলে আছে, তারা সবকিছুতেই মাঝারি। তারা পড়াশোনাতে সেরকম ভাল না, তাদের কাপড় চোপড়ও সাদাসিধে, কথাবার্তাও খুব সাধারণ। তারা স্কুলে বেশি কথাবার্তা বলে না, ঝগড়াঝাটি করে না, তাদের ধাক্কা দিলে মুখ কাচুমাচু করে সরে যায়। তাদের বাবারা সাধারণত গরিব মানুষ, স্কুলের মাস্টার, অফিসের কেরানী না হয় দোকানদার। নিরীহ বলে যে একটা কথা আছে সেটা মনে হয় তৈরিই। করা হয়েছে এই ছেলেদের জন্যে।