আমি চোখে মুখে বিস্ময়ের ভান করে বললাম, কি সুন্দর! আমাকে একটা ক্যাপসুল দেবেন?
লোকটা খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি ক্যাপসুল দিয়ে কি করবে?
সাজিয়ে রাখব।
লোকটা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল আমি ঠাট্টা করছি কিনা। আমি চোখে মুখে যতটুকু সম্ভব একটা সরল ভাব ফুটিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম। লোকটা বলল, ওষুধ কি সাজিয়ে রাখার জিনিস?
কি হয় সাজিয়ে রাখলে? মানুষ সুন্দর জিনিস সাজিয়ে রাখে না?
লোকটা আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না, অসম্ভব বোকার মত কোন প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল। লোকটা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার হি হি করে হাসতে শুরু করল, কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারে না।
হাসতে হাসতে সে সত্যি সত্যি শিশিটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে একটা ক্যাপসুল বের করে আমার হাতে দিয়ে দিল। আমি যখন ক্যাপসুলটা নিয়ে বের হচ্ছি তখনো সে হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভারি মজার মানুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু বাবার ভেজাল ওষুধের একটা প্রমাণ সে হাতে হাতে দিয়ে দিল, নিজে না জেনেই!
১০. বিস্ফোরণ
বৃহস্পতিবার দিনটিতে মনে হয় গোড়া থেকেই কিছু গোলমাল ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি লাবলুর জ্বর। মাঝে মাঝেই কেন জানি লাবলুটার জ্বর উঠে। তখন কেমন যেন চুপচাপ হয়ে শুয়ে থাকে। দেখেই কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায়।
স্কুলে গিয়েও গোলমাল। ক্লাস কেপ্টেন খামাখা আমার নাম লিখে স্যারের কাছে। নালিশ করল, আমি নাকি ক্লাশে গোলমাল করেছি। স্যার তখন আমাকে একেবারে যা তা বলে বকাবকি করলেন। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেল সেই বকাবকি শুনে।
টিফিন ছুটির সময় কাশেম আমার একটা বই কেড়ে নিল। লাইব্রেরি থেকে এনেছি, এখনো পড়া হয়নি। সেটা ফেরৎ নিতে গিয়ে মহা গোলমাল, ছোটখাট ধাক্কাধাক্কি ছাড়া অবশ্যি আর কিছু হল না, সলীল পাশে না থাকলে মনে হয় মার খেয়ে ভূত হয়ে যেতাম।
বিকাল বেলা হঠাৎ দেখি, কলম থেকে কালি চুঁইয়ে শার্টের পকেটটা মাখামাখি হয়ে গেছে, বাসায় পৌঁছানোর পর মা যা একটা কাণ্ড করবেন সেটা আর বলার নয়।
স্কুল ছুটির পর বাসায় আসতে আসতে রাস্তার মোড়ে আমি একটা আছাড় খেলাম। শুকনো ঠনঠনে রাস্তা, আছাড় খাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কিন্তু আমি তার মাঝে আছাড় খেয়ে ফেললাম। একটা দিন কেমন যাবে সেটা মনে হয় গ্রহ নক্ষত্র দিয়ে বিচার করা যায়। আজকে নিশ্চয়ই সবগুলি গ্রহ নক্ষত্র আমার জন্যে সবচেয়ে খারাপ খারাপ জায়গায় গিয়ে হাজির হয়েছে। আছাড় খেয়ে হাঁটুর ছাল উঠে গেছে কিন্তু সেটা। নিয়ে আমি ব্যস্ত হতে পারলাম না। সামনে নিচু ক্লাসের কয়জন ছেলে ছিল, তারা এমন জোরে হাসতে শুরু করল যেন ভারি মাজার একটা ব্যাপার হয়েছে। মানুষ আছাড় খেলে যে দেখে হাসতে হয় না এই জিনিসটা মনে হয় কেউ তাদের শেখায়নি।
দিনটা যে খুব খারাপ যাচ্ছে সেটা নিয়ে একেবারে নিঃশন্দেহ হয়ে গেলাম যখন বাসায় এসে দেখি, বাবা এসেছেন। অনেক দূর থেকে তাঁর ঘড়ঘড় শব্দ করে জিব পরিষ্কার করার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আজকে বাবার আসার কথা নয় কিন্তু আমার সর্বনাশ পুরো করার জন্যে মনে হয় একদিন আগে এসে হাজির হয়েছেন।
বাসায় ঢোকার আগে খানিকক্ষণ বারান্দায় বসে রইলাম। মনটা এত খারাপ হয়েছে। যে বলার নয়। মনে হতে লাগল, সলীলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বেদে হয়ে যাওয়াটা এমন কিছু খারাপ ব্যাপার নয়। পড়াশোনা করে কি হবে?
আমাকে দেখেই বাবার মুখ শক্ত হয়ে গেল কিন্তু আমাকে কিছু বললেন না। প্রত্যেকবারই বাবা পুরো ব্যাপারটা আগেরবার থেকে একটু ভিন্ন ভাবে করেন। কোন কথা না বলাটা মনে হয় একটা নতুন কায়দা।
আমি বাবাকে পাশ কাটিয়ে টেবিলের উপর বইগুলি রেখে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হলাম। মা চুলা থেকে ডেকচিটা নামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, নতুন শার্টটা এইভাবে নষ্ট করেছিস?
কলম থেকে কালি বের হয়েছে–
মা গর্জন করে বললেন, সাবধানে রাখতে পারিস না? কোন জংগলের ভূত হয়েছিস তুই?
সস্তা কলম, আমি কি করব?
সস্তা কলম? মা মুখ খিঁচিয়ে বললেন, লাট সাহেবের জন্যে সোনার কলম কিনে আনতে হবে!
আমি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে এলাম, এমনিতে বাবার পিটুনী খেয়ে আসছি, এখন। তার সাথে মায়ের মুখ খিচুনী যোগ হল। জীবনের উপর বিতৃষ্ণা এসে গেল হঠাৎ। রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, তখন হঠাৎ দেখি বাবা শোবার ঘর থেকে লাবলুর কান ধরে টেনে আনছেন। লাবলুর মুখ ভয়ে একেবারে ছাইয়ের মত সাদা হয়ে গেছে। একটু আগে দেখেছি জ্বরে কাহিল হয়ে লাবলু বিছানায় শুয়ে আছে। তাকে যে বাবা কান ধরে টেনে আনবেন আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
আমার মাথার মাঝে হঠাৎ কেমন জানি একটু গোলমাল হয়ে গেল। কেমন করে হল বা কেন হল সেটা আমি জানি না কিন্তু কিছু একটা ঘটে গেল তাতে কোন সন্দেহ। নেই। আমি তখন হঠাৎ একটা অসম্ভব সাহসের কাজ করে ফেললাম। রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হুকুম দেওয়ার মত করে বললাম, বাবা, লাবলুকে ছেড়ে দেন।
বাবার মাথার উপর বাজ পড়লেও মনে হয় বাবা এত অবাক হতেন না। তাঁর মুখ মাছের মত হা হয়ে গেল, চোখ দুটি গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শুধু যে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন তাই নয়, সত্যি সত্যি লাবলুকে ছেড়ে দিলেন। তাকে দেখে মনে হতে লাগল তাঁর ভিতরে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে। কি হচ্ছে কিছুই আর বুঝতে পারছেন না। কয়েক সেকেন্ড সেভাবে গেল, তারপর হঠাৎ করে বাবা নড়ে উঠলেন, তার চোখ মুখ হাত পা শরীর কেমন যেন কিলবিল করে উঠল। মুখ বন্ধ করে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, কি বললি?