খালি কি?
তালেব আলী –জয়নাল অনিশ্চিতের মত থেমে গেল।
তালেব আলী কি?
তালেব আলীর খোঁজ নাই আজ কয়েক মাস।
তালেব আলীটা কে?
আরেকজন মিস্ত্রি।
তার খোঁজ নেই?
না। কিন্তু তালেব আলী পাগলা কিসিমের। মনে হয় নিজেই কোথাও চলে গেছে।
তালেব আলী কি তোর ফিরিশতা ডাক্তারের কাছে যেতো?
জয়নাল দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল।
আর কেউ কি মারা গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে?
রইস।
রইসটা কে?
জুতা পালিশ করত। বাপের সাথে ঝগড়া করে চলে গেল।
কোথায় চলে গেল?
কেউ জানে না। রইসের অনেক মাথা গরম।
তুই কেমন করে জানিস মাথা গরম? নাওয়াজ খান হয়তো —
জয়নাল ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, না মুনীর ভাই। গরিব মানুষের পোলাপান। এইভাবেই মানুষ হয়। এক জায়গায় কয়দিন থাকে, তারপর সেখান থেকে আরেক জায়গায়। তারপর আরেক জায়গায়।
কি বলিস তুই জয়নাল?
ঠিকই বলি।
তিন তিনজন ছেলে তোর ফিরিশতা ডাক্তারের কাছে যেতো। তিনজনই শেষ আর তুই বলছিস–
বড় মানুষেরা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে যেভাবে মাথা নাড়ে জয়নাল সেভাবে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, মুনীর ভাই, গরিবের পোলাপান মরে অনেক বেশি। সেইদিন একজন ট্রাকের নিচে পড়ে শেষ। এখন আপনি কি বলবেন সেইটাও ডাক্তার সাহেব মেরেছে?
তা আমি জানি না। কিন্তু তুই –খবরদার, আর কখনো গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকে যাবি না। ঠিক আছে?
জয়নাল কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
বল, তুই আর কোন দিন যাবি না। বল।
জয়নাল খুব অনিচ্ছার সাথে বলল, ঠিক আছে যাব না।
তার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারলাম সে কথাটা বলেছে আমাকে ঠাণ্ডা করার জন্যে। যখন দরকার হবে তখন সে ঠিকই যাবে তার ফিরিশতার মত ডাক্তার নাওয়াজ খানের কাছে! আমার কথা সে একটুও বিশ্বাস করেনি। কিন্তু আমি আর কি করতে পারি?
জয়নালের কাছে রশীদের খুন হয়ে যাবার খরব পেয়ে আমি গেলাম সলীলের সাথে দেখা করার জন্যে। সলীল বাসায় নেই, তার কোন মাসীর বাড়ি বেড়াতে গেছে। আমি কি করব বুঝতে না পেরে ফিরে আসছিলাম চৌরাস্তার মোড়ে হঠাৎ মীনা ফার্মেসীটা চোখে পড়ল। এটা মতি মিয়ার ফার্মেসী, বাবা এখানে ওষুধ বিক্রি করেন।
ফার্মেসীতে মতি মিয়া আর তার একজন কর্মচারী বসে ছিল। এই কর্মচারীটি নতুন এসেছে, কমবয়সী হাসিখুশি একজন মানুষ। মতি মিয়া আমাকে দেখে খামাখা একটু মাতব্বরীর ভান করে বলল, কি খবর?
আমি বললাম, ভাল।
পড়াশোনা কর, নাকি খালি ঘোরাঘুরি?
আমার একটু মেজাজ গরম হল, নিজে চোরাই ওষুধ বিক্রি করে কিন্তু আমার উপর খবরদারি। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, খালি ঘেরাঘুরি।
আমার কথা শুনে কমবয়সী হাসিখুশি কর্মচারীটি হঠাৎ হি হি করে হেসে উঠল, কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারে না। মতি মিয়া চটে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি বললে?
না, কিছু না।
অন্য মানুষটি তখনো হেসে যাচ্ছে, মতি মিয়া তাকে জোরে একটা ধমক দিল, চুপ করবে তুমি?
মানুষটির হাসার রোগ আছে, অনেক কষ্ট করে নিজেকে থামাল। মতি মিয়া আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, মুরুব্বীদের সাথে এইভাবে কথা বলা ঠিক না। আদব-লেহাজ বলে একটা কথা আছে।
আমি আর কথা বাড়ালাম না, দাঁড়িয়ে রইলাম। মতি মিয়া খানিকক্ষণ গজ গজ করে একসময় উঠে দাঁড়িয়ে তার কর্মচারীটিকে বলল, দোকানটা দেখ, আমি বাজারটা সেরে আসি।
জি আচ্ছা।
মতি মিয়ার পিছনে পিছনে আমিও উঠে যাচ্ছিলাম, কর্মচারীটি বলল, তোমার নাম কি?
আমি আমার নাম বললাম।
আজকে তুমি জব্বর দিয়েছ মতি মিয়াকে! জিজ্ঞেস করল, পড়াশোনা কর না কি খালি ঘোরাঘুরি। তুমি বললে ঘোরাঘুরি! হি হি হি হি —
লোকটা আবার হাসতে শুরু করে, কিছুতেই হাসি থামাতে পারে না। ব্যাপারটা মোটেও এত হাসির নয়, মানুষটার নিশ্চয়ই হাসির রোগ আছে। হাসি যত অর্থহীন হোক, এটা সব সময় সংক্রামক, একটু পরে আমিও হাসতে শুরু করলাম।
লোকটা ফার্মেসীর একটা আলমারি খুলে কি একটা কৌটা বের করে সেখান থেকে দুইটা ট্যাবলেট বের করে একটা টপ করে মুখে দিয়ে আরেকটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কি এটা?
খেয়ে দেখ। ভিটামিন সি। অনেক মজা খেতে।
আমি সাবধানে মুখে দিয়ে দেখি সত্যিই তাই। চুষে চুষে খেতে খেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি সব ওষুধ চিনেন?
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলল, না চিনলে চলে?
আমি লাল রঙের একটা বোতল দেখিয়ে বললাম, ঐটা কি ওষুধ, বলেন দেখি।
লোকটা মাথা চুলকে বলল, হয় ব্লাড প্রেশার না হয় ডায়াবেটিস।
সত্যি মিথ্যা কে জানে। আমি আরো কয়েকটা জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা কিছু না কিছু বলে দিল। কথা শুনে মনে হল বানিয়েই বলছে –আমি অবিশ্যি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। হঠাৎ আলমারিটার উপরে এক জায়গায় দেখি, বাবার ভেজাল ওষুধগুলি সাজানো। আমি হাত দিয়ে দেখিয়ে বললাম, ঐটা কিসের ওষুধ?
ঐটা এন্টিবায়োটিক্স।
সেটা দিয়ে কি হয়?
ইনফেকশান হলে খেতে হয়।
কিসের ইনফেকশান?
কত রকম ইনফেকশান আছে! কিডনি, লিভার, ব্রেন। লোকটা খুব গম্ভীর ভাব করে হাত নেড়ে বলল, এন্টিবায়োটিক্স ছাড়া আজকাল একটা দিনও যায় না।
হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। আমি চোখে মুখে একটু অবাক হবার ভান করে বললাম, আমাকে ওষুধটা দেখাবেন? একটু দেখি।
লোকটা মুখে তাচ্ছিল্যের ভান করে ওষুধের বাক্সটা নামিয়ে এনে খুলে শিশিটা বের করে আমাকে দেখাল, বলল ক্যাপসুল।