জারুল চৌধুরী বললেন আমরা যখন খুশি তাঁর গাছঘরে আসতে পারি। এমনিতে গাছঘরে তালা দেয়া থাকবে। নিচে গাছের ফোকড়ে একটা ছোট প্লাস্টিকের কৌটায় চাবিটা রাখবেন। গাছঘরে শুকনো খাবার, পড়ার বই, স্লিপিং ব্যাগ, মোমবাতি সব কিছু রাখা থাকবে। আমরা যদি চাই কোনদিন রাতেও এসে থাকতে পারি।
জারুল চৌধুরীর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন হঠাৎ সলীল আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, জারুল স্যারকে বলবি?
কি?
তোর সেই কঠিন সমস্যাটা?
আমি প্রথমে মাথা নেড়ে বললাম, না না না—
কেন না?
আমার লজ্জা করছিল এবং সেটা বলতেও আমার লজ্জা করল। সলীল তখন আবার খোঁচা দিয়ে বলল, বল না।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখলাম। আসলেই ব্যাপারটা খারাপ হয় না। জারুল চৌধুরী মনে হয় বলতে পারবেন কি করা যায়। আমি একটু ইতঃস্তত করে সমস্যাটা খুলে বললাম, মানুষটা যে বাবা সেটা আর বললাম না, কিন্তু মনে হল তিনি বুঝে গেলেন।
আমার কথা শুনে তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমার শুনে খুব খারাপ লাগল মুনীর যে তুমি এত ছোট মানুষ। কিন্তু তোমার এত বড় সমস্যা। কিন্তু মুনীর, জেনে রাখ, তুমি একা না। তোমার মত অনেকে আছে। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমারও একই সমস্যা ছিল। বড় বড় মানুষ ছিল যাদেরকে লোকজন সম্মান করত কিন্তু আমি জানতাম তারা কত বড় বদমাইশ। আমি ছোট ছিলাম, তাই ভান করতাম কিছু বুঝি না, কিন্তু আসলে সবই। বুঝতাম। তোমাদের এরকম হয় না?
আমরা মাথা নাড়লাম।
তোমাদের শুধু একটা জিনিস বলে রাখি। তোমরা যেটা সত্যি জান কখনো সেটা থেকে বিশ্বাস হারাবে না। বড় মানুষেরা বদমাইশ হয় হোক, তোমরা কখনো বদমাইশ হবে না। বড় মানুষেরা যে কাজ করে তার সব কাজ ভাল সেটা সত্যি না।
আমরা আবার মাথা নাড়লাম।
আর মুনীর, তোমার যে সমস্যা সেটা খুব সহজ সমস্যা না। অনেক কঠিন সমস্যা। এটা সমাধান করতে হবে বুদ্ধি খাঁটিয়ে। তোমরাও ভাব, আমিও ভাবি। নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের হবে। যদি কোন বুদ্ধি বের করতে পার আগে আমাকে জানিও! তারপর দেখি কি করা যায়! কি বল?
আমি আর সলীল আবার মাথা নাড়লাম। বাসায় আসার সময় আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকলাম। সত্যি কথা বলতে কি, বাসায় আসতে আসতে বেশ কয়েকটা বুদ্ধি বের হয়ে গেল।
০৯. খুন
বিকাল বেলা বাসা থেকে বের হচ্ছি, দেখি, সিঁড়িতে জয়নাল বসে আছে। জয়নাল হাসিখুশি মানুষ, কোন সময় মন খারাপ করে থাকে না। যখন তার হাসিখুশি হওয়ার কোন কারণ নেই তখনো সে হাসিখুশি! আজকে কিন্তু জয়নালকে দেখে মনে হল তার মন খারাপ। গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখেও কিছু বলল না। আমি কাছে গিয়ে বললাম, কি রে জয়নাল!
তবু সে উত্তর দিল না। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, কি রে জয়নাল? কি হয়েছে?
জয়নাল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার রশীদের কথা মনে আছে?
রশীদ? আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে করতে পারলাম না।
জে। রশীদ। মিনতির কাজ করত। একদিন নদীর ঘাটে নতুন কাপড় পরে। এসেছিল। তখন আমি —
হ্যাঁ হ্যাঁ, যে তোকে ফিরিশতার মত ডাক্তার নাওয়াজের খোঁজ দিয়েছে?
জয়নাল চমকে উঠে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ স্ স্ স্ আস্তে। কেউ শুনবে।
কে শুনবে? কেউ নাই এখানে। কি হয়েছে রশীদের?
মরে গেছে।
মরে গেছে? আমি চমকে উঠে বললাম, মরে গেছে?
জে।
কেমন করে মরে গেল?
পানিতে ডুবে।
পানিতে ডুবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, সাঁতার জানত না?
জয়নাল একটু হাসার মত ভঙ্গি করে বলল, কি বলেন আপনি মুনীর ভাই! পানির পোকা ছিল একেবারে! মাছের মত সাঁতার দিত।
তাহলে ডুবে গেল কেন?
জয়নাল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার কি মনে হয় জানেন?
কি?
কেউ একজন মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। লুঙ্গির খুট দিয়ে চোখ মুছে জয়নাল বলল, রশীদ পানিতে ডুবে মরার মানুষ না। শুক্রবারে দেখা হল ভাল মানুষ। তারপর দেখা নাই। এখন শুনি মরে গেছে! বিশ্বাস হয়?
জয়নাল!
জে?
তুই জানিস আমার কি মনে হয়?
কি?
নাওয়াজ খান মেরেছে।
জয়নাল এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি বললাম, নাওয়াজ খান অনেক ডেঞ্জারাস মানুষ!
আপনি কি বলেন মুনীর ভাই! ফিরিশতার মত মানুষ–
জয়নাল। নাওয়াজ খান ফিরিশতার মত মানুষ না—
আপনি কেমন করে জানেন?
আমি? আমি–মানে ইয়ে–আমি আমতা আমতা করে থেমে গেলাম, আমি আর সলীল যে তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেটা বলতে পারলাম না। জয়নাল সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমাদের ক্লাসের একজন চিনে। সে বলেছে।
জয়নাল আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করল বলে মনে হল না। মাথা নেড়ে বলল, একজন ভাল মানুষের বদনাম করা ঠিক না।
তুই কেমন করে জানিস সে ভাল মানুষ?
আমি জানি। আমরা গরীব মানুষ, আমাদের কেউ খোঁজখবর নেয় না। ডাক্তার। সাহেব আমাদের খোঁজখবর নেন। টাকা পয়সা দেন।
জয়নাল, তুই আমার কথা শোন। খবরদার, তুই আর কোনদিন গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকে যাবি না। খবরদার।
জয়নাল আমার কথার উত্তর দিল না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, রশীদ ছাড়া তোর পরিচিত আর কেউ মারা গেছে?
জয়নাল মাথা নাড়ল, না। কেউ মারা যায় নাই। খালি—