মোটেও পাগল না। আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, জারুল চৌধুরী মোটেই পাগল না। অনেক ভালমানুষ।
টাক মাথার মানুষটি হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল, দেখি, আমি দুজনের সাথে একটু কথা বলে দেখি। আস খোকারা, আমার কাছে আস। কি যেন নাম জামাল আর কি —
সলীল আর মুনীর।
ও আচ্ছা। সলীল আর মুনীর। আস, কাছে আস।
আমরা এগিয়ে গেলাম।
বুঝেছ খোকারা, এটা অনেক বড় ব্যাপার। দেশের উন্নতির জন্যে কলকারখানা তৈরি করতে হয়, বাড়িঘর তৈরি করতে হয়। তার জন্যে ইট লাগে, সিমেন্ট লাগে। ইট তো আর গাছে ধরে না, ইট তৈরি করতে হয়। সে জন্যে ইটের ভাটা খুব জরুরি। আর তাই আমাদের এই জায়গাটা দরকার। এমনিতে পড়ে আছে, জংলা জায়গা, সাপখোপের আড্ডা। তোমাদের কি দেখে ভাল লাগল কে জানে। যাই হোক, ভাল যখন লেগেছে তোমরা এখানে যখন খুশি বেড়াতে আসবে। আমি বলে রাখব, যখন খুশি তোমরা আসতে পারবে।
ইটের ভাটায়?
মানুষটা না শোনার ভান করে বলল, তোমরা যদি এই কাগজটায় সাইন করে দাও তাহলে কি করব জান?
কি?
দুইজনকে দুইটা সাইকেল কিনে দেব। নতুন সাইকেল। একেবারে ব্ৰাণ্ড নিউ। কি বল, হ্যাঁ?
নতুন সাইকেল? আমার বুকের ভিতর একেবারে ছলাৎ করে উঠে। সলীল অবশ্যি গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, সাইকেল চাই না।
তাহলে কি চাও?
কিছু চাই না।
মানুষ দুজন চোখ দুটি দিয়ে আগুন বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা চোখ সরালাম না, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ এভাবে কেটে গেল, তখন হঠাৎ একজন উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলে একটা থাবা দিয়ে বলল, এই জন্যে সব সময়। বলি পাগল ছাগলের সাথে কখনো বিজনেস করতে হয় না।
অন্যজনও তখন উঠে দাঁড়াল, টেবিল থেকে কাগজটা নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলল, ছেলেপিলে ঠিক করে মানুষ হয় না আজকাল। আমাদের সময় শক্ত পিটুনি দেয়ার নিয়ম ছিল, বেয়াদব ছেলেরা একেবারে সিদে হয়ে যেতো।
হেডস্যার হাসি হাসি মুখে বললেন, আমি মাস্টার মানুষ, আমিও বেয়াদপি একেবারে সহ্য করি না। আমার ছেলেরা আর যাই করুক কোন বেয়াদবি করেনি।
মানষ দুইজন নাক দিয়ে এক ধরনের শব্দ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। হেডস্যার সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথা নাড়লেন, তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল যেন খুব মজার একটা জিনিস দেখেছেন।
আমি হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম, যাব স্যার আমরা?
যাও।
আমরা বের হয়ে যাচ্ছিলাম, হেড স্যার আবার জিজ্ঞেস করলেন, দিনরাত শুধু বন জংগলে ঘোরাঘুরি কর, নাকি পড়াশোনাও কর?
পড়াশোনাও করি স্যার।
রোল নাম্বার কত?
তিন।
হেডস্যার আমার দিকে তাকালেন, আমি উদাস উদাস মুখ করে বললাম, তেইশ!
তেইশ? পড়াশোনা করলে রোল নাম্বার তেইশ হয় কেমন করে?
আমি কিছু বললাম না, বলার কিছু ছিলও না। হেডস্যার বললেন, যাও ক্লাসে যাও।
আমরা বের হয়ে যাচ্ছিলাম, হেডস্যার আবার আমাদের থামালেন, যে জায়গাটা নিয়ে এত হৈ চৈ সেটা কি আসলেই সুন্দর?
জ্বী স্যার। অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সলীল হাত নেড়ে বলল, আপনি দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবেন।
একবার নিয়ে যেও তো আমাকে।
নিয়ে যাব স্যার। আপনি বললে আমরা নিয়ে যাব। আপানার যখন ইচ্ছে।
আর ঐ প্রফেসর সাহেব, সত্যিই কি গাছের উপর থাকেন?
সব সময় না স্যার, মাঝে মাঝে। গাছের উপর চমৎকার ঘর স্যার, থাকতে কোন অসুবিধে নেই।
ও, আচ্ছা। ঠিক আছে তোমরা যাও।
আমরা বাইরে যেতে যেতে দেখলাম, হেড স্যার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। বাইরে দুটি বড় বড় গাছ, স্যার সেই গাছের দিকে কেমন জানি একরকম মুখ করে তাকিয়ে আছেন। কে জানে স্যারের হয়তো ছেলেবেলার কথা মনে পড়েছে!
০৮. ওষুধ ফ্যাক্টরি
বাসায় এসে দেখি বাইরে লুঙ্গি ঝুলছে এবং ভিতর থেকে বাবার জিব পরিষ্কার করার বিকট শব্দ বের হচ্ছে। পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকে দেখলাম, রান্নাঘরে মা রাঁধছেন এবং রান্নাঘরের দরজার পিছনে লাবলু দাঁড়িয়ে ফোঁসফোঁস করে কাঁদছে। আমি টেবিলের উপর বইগুলি রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। শিউলি গাছটা বেশ বড়োসরো হয়েছে। নিচে আর কোন ডাল নেই, বাবা আজ কোন ডালটা ভাঙবেন কে জানে। আমি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললাম। সলীলের সাথে বাসা থেকে পালিয়েই যেতে হবে, এভাবে আর থাকা যায় না।
সে রাত্রে খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, বাবা আমাদের মারলেন না। মারতে চাননি সেটা অবিশ্যি সত্যি নয়, কিন্তু ঠিক সময় করে উঠতে পারলেন না। মগরেবের নামাজ পড়েই বাবা টেবিলের ওপর কয়েকটা খবরের কাগজ বিছিয়ে কি একটা কাজ শুরু করে দিলেন। টেবিলের ওপর শিশি বোতল প্যাকেট রাখতে রাখতে বাবা আমাকে আর লাবলুকে খুব খারাপ খারাপ কথা বলে গালি দিতে লাগলেন। আমাকে বললেন শুওরের বাচ্চা, বদমাইশ, জানোয়ার এবং হারামখোর। লাবলুকে বললেন কুত্তার বাচ্চা, ইবলিশ, বেতমিজ এবং জুতাচোর। হ্যাঁচকা টান মেরে আমার কান ছিঁড়ে ফেলবেন এবং চড় মেরে লাবলুর সবগুলি দাঁত ফেলে দেবেন বলে হুমকি দিতে লাগলেন। গালিগালাজ এবং এরকম হম্বিতম্বিকে আমি অবিশ্যি বেশি ভয় পাই না। সত্যিকার পিটুনী হলে অন্য কথা।
যে কাজটা করার জন্যে বাবা আমাদের মারতে পর্যন্ত সময় পাচ্ছেন না সেটা কি আমার খুব জানার কৌতূহল হচ্ছিল। বাবা সেটা লুকানোর চেষ্টাও করলেন না, কাজেই আমরা সবাই দেখলাম। প্রত্যেকবার বাবা অফিস থেকে ওষুধ চুরি করে আনেন। এবারে শুধু ওষুধ নয়, ওষুধের সাথে অনেকগুলি ওষুধের খালি বাক্স আর শিশি এনেছেন। সাথে আরেকটা ঠোঙা ভর্তি ক্যাপসুল। ক্যাপসুলগুলি খালি। ক্যাপসুল যে খালি হতে পারে এবং সেটাকে টেনে খুলে ফেলা যায় আমি জানতাম না। বাবা সেই ক্যাপসুলগুলি খুলে ভিতরে একটু ময়দা ভরে সেগুলি আবার বন্ধ করে রাখতে লাগলেন। তারপর ওষুধের শিশির মাঝে গুনেগুনে কুড়িটা করে ক্যাপসুল রেখে মুখটা বন্ধ করে বাক্সের। মধ্যে রাখতে শুরু করলেন। একেবারে নিখুঁত কাজ, দেখে আমাদের তাক লেগে গেল। বাবার মুখ গম্ভীর দেখে মনে হয় সাংঘাতিক একটা জরুরি কাজ করছেন।