লোক দুজন আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, খুব চেষ্টা করছে হাসি হাসি মুখ করে তাকাতে, কিন্তু কেন জানি আমার মনে হল লোক দুজন কোন কারণে আমাদের উপর। রেগে আছে। টাক মাথার মানুষটি মুখের হাসিটাকে আরো বড় করে গলায় মধু ঢেলে বলল, খোকারা, কেমন আছ?
ভাল।
বেশ। বেশ। বেশ। লোকটা পুতুলের মতো মাথা নেড়ে আবার বলল, বেশ। বেশ। বেশ।
দুই নম্বর মানুষটি, যার চোখে চশমা এবং নাকের নিচে বড় বড় গোঁফ, মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার ঢাকা থেকে এসেছি, বিকেলের ট্রেনে চলে যাব।
আমি আর সলীল দুজনেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাদের ডেকে . পাঠানোর সাথে বিকেলের ট্রেনে তাদের ঢাকা ফিরে যাবার কি সম্পর্ক এখনো ঠিক বুঝতে পারলাম না।
টাক মাথার লোকটি বলল, আমরা এখানে এসেছি একটা বিজনেসের ব্যাপারে।
চশমা চোখের লোকটি বলল, আমাদের অনেক রকম বিজনেস। গার্মেন্টস, শিপিং, প্লাস্টিক, আরো অনেক কিছু।
টাক মাথার লোকটা বলল, আহসান এন্টারপ্রাইজ বললে সবাই এক নামে চেনে। যাই হোক যেটা বলছিলাম, আমরা একটা জমি কিনব প্রফেসর জহুরুল চৌধুরীর কাছে। থেকে। অংকের প্রফেসর–
টাক মাথার মানুষটি হঠাৎ খুব জোরে জোরে হাসতে শুরু করল, যেন অংকের প্রফেসর হওয়া খুব একটা হাসির ব্যাপার। আমি আর সলীল একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, তখনো রহস্যটার সমাধান হয়নি কিন্তু যোগাযোগটা কিভাবে হয়েছে মনে হয় একটু একটু আন্দাজ করেত পারছি।
চশমা চোখের মানুষটি বলল, প্রফেসর সাহেব খুব মজার মানুষ। খুব খেয়ালী মানুষ!
জ্ঞানী মানুষেরা সাধারণত খেয়ালী হয়। প্রফেসর জি. সি. দেব ছিলেন জ্ঞানী মানুষ। একবার নাকি ক্লাসে ভুল করে মশারী পরে চলে এসেছিলেন! পাকিস্তান আমী মেরে ফেলেছিল সেভেন্টি ওয়ানে। দেশের একটা বিগ লস। চশমা চোখের মানুষটা জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করল।
টাক মাথার মানুষটা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, খোকারা, তোমরা বিশ্বাস করবে না, প্রফেসর জহুরুল চৌধুরী কি রকম মজার মানুষ শুনো। তার কাছ থেকে আমরা, আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, একটা জমি কিনছি। আর প্রফেসর সাহেব কি করলেন জান?
কি?
বলেছেন একটা কাগজে তোমাদের দুজনের সিগনেচার নিয়ে আসতে! সেই কাগজে তোমরা লিখে দেবে এই জমি বিক্রি করিতে আমাদের কোন আপত্তি নাই।” টাক মাথার মানুষটি আবার দুলে দুলে হাসতে শুরু করল।
চশমা চোখের মানুষটি আঙুল দিয়ে তার বড় বড় গোফ টানতে টানতে বলল, তোমাদের মনে হয় খুব স্নেহ করেন। গাছের উপরে একটা ঘর তৈরি করছেন, সেখানে নাকি তোমরা গিয়েছ?
আমরা মাথা নাড়লাম।
চশমা চোখের মানুষটি হঠাৎ মুখটাকে একজন দার্শনিকের মত করে বলল, আসলে যারা বড় মানুষ তারা সব সময় বাচ্চাদের ভালবাসেন। বাচ্চাদের মাঝে এক ধরনের ইনোসেন্স থাকে যেটা আমরা টের পাই না! যারা সত্যিকারের বড় মানুষ তারা সেটা চট করে ধরতে পারে।
টাক মাথার মানুষটি আবার পুতুলের মত জোরে জোরে মাথা নাড়ল। চশমা চোখের মানুষটি টেবিলের উপরে রাখা কাগজটা আমাদের দিকে এগিয়ে বলল, আমি তোমাদের ঝামেলা কমানোর জন্যে কাগজে টাইপ করে এনেছি –”এই জমি বিক্রি করিতে আমাদের কোন আপত্তি নাই”। তোমরা নিচে তোমাদের নাম লিখে দাও। কিসে লিখবে? ইংরেজিতে, না বাংলায়?
সলীল একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, কিন্তু আমাদের আপত্তি আছে।
অ্যাঁ? মনে হল মানুষটা ঠিক বুঝতে পারল না সলীল কি বলছে।
আমাদের আপত্তি আছে। ঐ জায়গাটা বিক্রি করায় আমাদের আপত্তি আছে।
তোমাদের আপত্তি আছে?
হ্যাঁ। আমি আর সলীল মাথা নাড়লাম।
জমিটা কি তোমাদের? তোমার ফ্যামিলির?
না।
তাহলে তোমার আপত্তি আছে মানে?
তবু আপত্তি আছে। জায়গাটা খুব সুন্দর, স্কুল ছুটি হলে আমরা সেখানে বেড়াতে যাই। আপনারা জায়গাটা কিনে সেখানে ইটের ভাটা বানাবেন। সব গাছ কেটে ফেলবেন। আমাদের সে জন্য আপত্তি আছে।
লোক দুজন আস্তে আস্তে রেগে উঠল। মানুষ রেগে গেলে তাদের খুব খারাপ দেখায়, এই দুজনকেও খুব খারাপ দেখাতে লাগল। মাথায় টাক মানুষটাকে কেমন যেন মোষের মত দেখাতে লাগল। সে ফোঁৎ করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এটা মশকরা করার জায়গা না। নাও এখানে সাইন কর।
উঁহু। লোকটা এবারে হেডস্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, একটু বলবেন সাইন করতে।
হেডস্যার এতক্ষণ খুব কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। লোকটার কথা শুনে বললেন, আমার বলা তো ঠিক হবে না। আমি তো এর আগে পিছে কিছুই জানি না। প্রফেসর সাহেব যখন এদের অনুমতি চাইছেন, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন। কারণ আছে। আমি তাদের পড়াশোনা করতে বলতে পারি, হোমওয়ার্ক করতে বলতে পারি, কিন্তু এটা তো বলতে পারি না।
আমি আর সলীল কৃতজ্ঞ চোখে হেডস্যারের দিকে তাকালাম। কখনো বুঝতে পারিনি স্যার এরকম একটা কথা বলবেন। মনে করেছিলাম, কাগজটাতে সাইন করার জন্যে এমন একটা ধমক দেবেন যে, আমরা একেবারে কাপড় ভিজিয়ে ফেলে ছুটে গিয়ে সাইন করব।
চশমা চোখের লোকটি তার গোঁফে টান দিতে দিতে হেডস্যারের দিতে ঝুঁকে পড়ে বলল, কিন্তু স্যার, আপনি বুঝতে পারছেন না! অনেক বড় বিজনেস ডিল, একজন মানুষের পাগলামির জন্যে তো নষ্ট হতে পারে না।
পাগলামো?
অফকোর্স। প্রফেসর সাহেব বদ্ধ পাগল। জেলখানায় না হয় পাগলা গারদে আটকে রাখার কথা। বয়স্ক মানুষ, একটা গাছের উপর বসে থাকে, চিন্তা করতে পারেন?