নাওয়াজ খান চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, তোমাদের প্রশ্নটা যেন কি?
দেশের উন্নতির জন্যে আমাদের কি করা উচিৎ?
প্রত্যেকটা মানুষ যদি নিজের উন্নতি করে তাহলেই দেশের উন্নতি হবে।
কিন্তু, কিন্তু-–
কিন্তু কি?
একজন যদি খুব গরিব হয়, পড়াশোনা করতে না পারে, কোন সুযোগ না পায়, তাহলে সে নিজের উন্নতি কেমন করে করবে?
সেরকম মানুষের কথা ভুলে যাও।
ভুলে যাব?
হ্যাঁ। তারা সমাজের বোঝা। দেশের বোঝ।
বোঝা?
হ্যাঁ। সেরকম মানুষ যত কম হয় তত মঙ্গল।
কিন্তু —
নাওয়াজ খান জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অন্যমনস্কের মত বললেন, পৃথিবীটা হচ্ছে একটা বিরাট ফুড চেইন। একদল আরেক দলকে খাচ্ছে। খেয়ে বেঁচে আছে। যার কপাল ভাল সে ফুড চেইনের উপরে, যার খারাপ সে নিচে। চেষ্টা করতে হয় ফুড চেইনের উপরে থাকতে যেন তোমাকে কেউ খেতে না পারে, কিন্তু তুমি অন্যকে খেতে পার।
নাওয়াজ খান কি বলতে চাইছেন আমি আর সলীল ঠিক বুঝতে না পেরে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। নাওয়াজ খান জানালার বাইরে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যারা গরিব, অশিক্ষিত, মূর্খ মানুষ তারা দুর্বল মানুষ। তারা ফুড চেইনের নিচে। তারা কোন কাজে আসে না। যদি কোনভাবে তাদের ব্যবহার করা যায়, ভাল। করা না গেলে নেই। তাদের নিয়ে মাথা ঘামালে দেশের কোন উন্নতি হবে না। দেশের উন্নতি করবে সমাজের যারা এলিট গ্রুপ, তারা। যারা জ্ঞানে-গুণে, বিদ্যায় বুদ্ধিতে তুখোড়, তারা। চেষ্টা কর সেরকম মানুষ হতে–
সলীল প্রতিবাদ করে আরো কি একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, এই মানুষটার সাথে কথা বলে কোন লাভ নেই। নাওয়াজ খান আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর কোন প্রশ্ন আছে?
আমরা মাথা নাড়লাম, না নেই।
যাও, তাহলে বাড়ি যাও।
গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিক থেকে হেঁটে আসতে আসতে সলীল বলল, নাওয়াজ খান মানুষটা অনেক ডেঞ্জারাস।
আমি বলেছিলাম না তোকে?
চোখের দিকে তাকালে কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
আমি আবার বললাম, তোকে বলেছিলাম না আগেই?
তোর জয়নালের মনে হয় অনেক বড় বিপদ হতে পারে। বলিস এই লোক থেকে দূরে থাকতে। একশ হাত দূরে থাকতে।
.
পারভেজ স্যারের রচনা লিখতে আমাদের একটু ঝামেলা হল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমি লিখলাম বৃন্দাবনের উপর, যে উকিল সাহেবের গরুর দুধ দোয়াতে আসে। থুরথুরে বুড়ো কিন্তু এই বয়সে সে রাস্তার একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মত করে বড় করেছে। সব সময় তার পিছনে পিছনে ঘুরে। সলীল লিখল একজন রিকশাওয়ালার উপরে, ভুল করে একবার রিকশায় একটা ব্যাগ ফেলে রেখে এসেছিল, রিকশাওয়ালা খুঁজে এসে ফেরৎ দিয়ে গেছে। ব্যাগে বেশ কিছু টাকা ছিল কিন্তু সে খুলেও দেখেনি!
০৭. আহসান এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড
ইতিহাস ক্লাসে সুনির্মল দপ্তরী একটা ছোট চিরকুট নিয়ে এল। ইতিহাস স্যার চিরকুটটা পড়ে ভুরু কুঁচকে ক্লাসের দিকে তাকালেন, তারপর মেঘ স্বরে বললেন, মুনীর আর সলীল–
আমি আর সলীল উঠে দাঁড়ালাম।
তোমাদের দুজনকে হেডস্যার ডেকে পাঠিয়েছেন।
শুনে আমাদের একেবারে আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। হেডস্যার ডেকে পাঠানো এখন পর্যন্ত কারো জন্যে কোন সুসংবাদ বয়ে আনেনি। এক কথায় বলা যায়, এটা সাক্ষাৎ মৃত্যুর আলামত। কি জন্যে আমাদের উপর এই মহা বিপর্যয় নেমে আসছে। সেটাই প্রশ্ন। সেদিনের স্কুল পালানোটা কি হেডস্যার জেনে গেছেন? কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? অন্য কেউ তো টের পায়নি। তাহলে কি বড়দের উপন্যাস পড়াটা? কিন্তু সেটাও তো খুব বেশি মানুষ জানে না। নাওয়াজ খানের চেম্বারে গিয়ে আমরা কি কিছু গোলমাল করে এসেছি? নাকি অন্য কিছু? গত কয়েক সপ্তাহে আমি যত অপকর্ম করে এসেছি সবগুলি একে একে মনে পড়তে লাগল।
ইতিহাস স্যারের কোন দয়া মায়া নেই বলে ধরে নেয়া হয়। ক্লাসে আবার সেটা প্রমাণ হল, স্যার মধুর ভঙ্গিতে হেসে বললেন, যাও বাবারা, একটু ধোলাই খেয়ে আস।
আমি আর সলীল ফ্যাকাসে মুখে সুনির্মল দপ্তরীর সাথে রওনা দিলাম। সলীল গলা নামিয়ে বলল, সুনির্মলদা, ব্যাপারটা কি?
সুনির্মলদা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে উদাস গলায় বললেন, আর ব্যাপার!
শুনে আমরা আরো ঘাবড়ে গেলাম।
হেডস্যারের রুমে গিয়ে পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখি, ভিতরে দুইজন মানুষ বসে আছে। দুজনেই মোটা এবং ফর্সা। বড়লোকদের এক রকম চেহারা হয়, তাদের চেহারা। সেরকম। একজনের মাথায় চুল পাতলা হয়ে এসেছে, অন্যজনের বড় বড় গোফ এবং চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আমরা ভারি পর্দার ভিতর দিয়ে মাথা গলিয়ে দুর্বল গলায় বললাম, স্যার আমাদের ডেকেছেন?
হ্যাঁ, ডেকেছি। এসো। হেডস্যার কথা শেষ করে আমাদের দিকে হাসিমুখে তাকালেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমি হেডস্যারকে কখনো হাসতে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। শুধু তাই নয়, স্যারের গলার স্বর মাখনের মত নরম, আমাদের নিজেদের কানকে বিশ্বাস হল না।
আমরা সাবধানে ভিতরে ঢুকলাম, এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত না ব্যাপারটা কোন রকম রসিকতা কিনা। হেডস্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা সলীল আর মুনীর?
জী স্যার। আমি মুনীর।
সলীল বলল, আমি সলীল।
হেডস্যার লোক দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে, যে দুজনকে আপনারা খুঁজছেন।