জারুল চৗধুরী খানিকক্ষণ নিজের ব্যাণ্ডেজ করা হাতটি দেখে বললেন, তারপর তোমরা মানিকজোড়, কি মনে করে? স্কুল পালিয়ে?
সলীল তার বইয়ের কথা বলতে যাচ্ছিল, জারুল চৌধুরী হাত তুলে থামিয়ে দিলেন। বললেন, বুঝেছি। নীল নয়নার অভিসার! তাই না?
আমরা মাথা নাড়লাম, মনে হল এখন বুঝি আমাদের ধমকে দেবেন এরকম একটা বই পড়ার জন্যে, কিন্তু ধমকে দিলেন না বরং হাসি হাসি মুখে বললেন, অনেকদিন এরকম একটা বই পড়িনি, তাই সেদিন বসে বসে পড়ে ফেললাম।
সলীল কোন কথা বলল না, জারুল চৌধুরী মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, কাহিনীটা জানি কি রকম! নীল নয়না চাকু দিয়ে তার ভালবাসার মানুষের বুক কেটে ফেলল, তারপর রক্তে হাত ভিজিয়ে বলল, যেও না যেও না ওগো–সেটা কি কখনো হয়?
সলীল দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল, কয়েকদিন আগেই সে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল কি দারুণ এই বইটা, কি চমৎকার তার ভাষা, কি সাংঘাতিক তার কাহিনী! কিন্তু এখন জারুল চৌধুরীর সামনে সে একেবারে চুপ মেরে রইল, একবারও প্রতিবাদ করল না।
জারুল চৌধুরী মনে হল বইয়ের কাহিনীটার কথা চিন্তা করে একবার একটু শিউরে উঠলেন, তারপর বললেন, যাবার সময় নিয়ে যেও বহঁটা।
ঠিক আছে।
আমরা সেই গাছঘরে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম। জারুল চৌধুরী তার লাল গামছায় চশমা পরিষ্কার করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কয়দিনেই জায়গাটার উপর মায়া পড়ে গেছে।
হ্যাঁ, এত সুন্দর গাছপালা! নিরিবিলি।
ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে।
আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ছেড়ে যাবেন?
হ্যাঁ। যেতে তো হবেই এক সময়ে।
তাহলে এত সুন্দর করে এই যে ঘর তৈরি করলেন?
শখ হয়েছে, তাই তৈরি করছি। এক সময়ে ছেড়ে যেতে হবে। সংসারে কিছু কি রাখা যায়? সব ছেড়ে যেতে হয়।
শুনে আমাদের একটু মন খারাপ হয়ে গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন আপনি?
ঢাকা। এ জায়গাটা আসলে বিক্রি করে দিচ্ছি। কেউ থাকে না, কোন কাজে আসে না।
সলীল আস্তে আস্তে বলল, সব কিছু কি কাজে আসতে হয়?
জারুল চৌধুরী কেমন যেন অবাক হয়ে সলীলের দিকে তাকালেন, তারপর আবার। চশমা খুলে মনোযোগ দিয়ে তার লাল গামছা দিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।
সলীল জিজ্ঞেস করল, যে জায়গাটা কিনছে সে কি করবে এখানে?
ইটের ভাটা তৈরি করবে।
ইটের ভাটা? আমি আর সলীল প্রায় চিৎকার করে বললাম, ইটের ভাটা?
হ্যাঁ। কাছেই নদী, নৌকায় ইট আনা নেয়া করা খুব সহজ হবে। জঙ্গলে গাছপালা আছে, কেটে লাকড়ি তৈরি করা হবে।
লাকড়ি?
জারুল চৌধুরী কেমন যেন অপরাধীর মত মুখ করে আমাদের দিকে তাকালেন। আমি মাথা নেড়ে বললাম, এটা যদি আমার জায়গা হত তাহলে কখনো এই জায়গা আমি বিক্রি করতাম না। কখনো না।
সলীলও আস্তে আস্তে বলল, আমিও করতাম না।
জারুল চৌধুরী কেমন যেন কাচুমাচু করে বসে রইলেন, দেখে মনে হল, তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেছে। মনে হল কিছু একটা চিন্তা করছেন। সলীল আবার বলল, আপনি চিন্তা করতে পারেন, এই সুন্দর জায়গাটা একটা ইটের ভাটা হয়ে যাবে? সব গাছ কেটে ফেলবে, শুকনো ধু ধু চারিদিকে, মাঝখানে ইটের ভাটা। সেখান থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। কাল কুচকুচে ধোঁয়া–
জারুল চৌধুরী মনে হল আরো দমে গেলেন। খানিকক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থেকে বললেন, তোমরা মনে হয় ঠিকই বলেছ। কিন্তু মুশকিলটা কি জান?
কি?
বড় হয়ে গেছি। যেটা করতে চাই সেটা আর করতে পারি না। কি করি জান? যেটা করা দরকার সেটা।
আমরা তিনজনই মন খারাপ করে একটা বড় গাছের উপর থেকে পা ঝুলিয়ে বসে রইলাম।
০৬. নাওয়াজ খান
গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকের সামনে এসে আমি আর সলীল দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলাম। সলীল এতক্ষণ বেশ বড় বড় কথা বলছিল, কেমন করে নাওয়াজ খানের সাথে দেশের উন্নতি নিয়ে কথা বলবে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট কেমন করে দূর করা যায় সেসব আলোচনা। করবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার উৎসাহ কেমন যেন মিইয়ে গেল। আমি বললাম, চল ফিরে যাই। খামাখা গিয়ে কি হবে? বড় মানুষ, উল্টো একটা ধমক দিয়ে বের করে। দেবে।
কেন ধমক দিয়ে বের করে দেবে?
বড় মানুষদের আক্কেল কম হয়, সেজন্য।
সলীল আমার দিকে চোখ পালিয়ে তাকিয়ে বলল, তোর ধারণা বড় মানুষ মাত্রই খারাপ, সেটা ঠিক না। পৃথিবীতে অনেক ভাল বড় মানুষ আছে। যদি একজন ভাল মানুষ থাকে তার দেখাদেখি আরো অনেক ভাল মানুষ বের হয়।
কচু হয়।
সলীল রেগে বলল, ধরে একটা থাবড়া দেব। কবি রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন তৈরি করেছিলেন, কত বড় বড় মানুষ যেখান থেকে বের হয়েছে জানিস?
আমি সলীলকে রাগানোর জন্যে হি হি করে হেসে বললাম, তুই ভাবছিলি নাওয়াজ খানকে নিয়ে আরেকটা শান্তিনিকেতন তৈরি করবি?
সলীল কিছু না বলে আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে গ্রীন মেডিকেল ক্লিনিকের সামনে দুইবার সামনে পিছনে হাঁটল। তারপর আমার মুখের কাছে আঙুল তুলে বলল, তোর যা ইচ্ছা হয় কর, আমি ভিতরে গেলাম।
তারপর আমি কিছু বলার আগে সত্যি সত্যি গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি একা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি কেমন করে, তাই সলীলের পিছনে পিছনে আমিও ঢুকে গেলাম। গেটের পিছনে রাস্তায় একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস। একজন মানুষ লাল রঙের একটা কাপড় দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়িটা মুছে পরিষ্কার করছে। মনে হয় মানুষটা ডাক্তার নাওয়াজ খানের ড্রাইভার। মানুষটা আমাদের দেখে ভুরু কুঁচকে। খামাখাই গলা উঁচিয়ে বলল, কি চাও?