নাওয়াজ খান।
কিন্তু তুই তো তাকে এখনো চিনিস না। তোকে লিখতে হবে এমন একজন মানুষকে নিয়ে যাকে তুই চিনিস।
সেটাই তো আইডিয়া। কাল পরশু কোন একদিন গিয়ে নাওয়াজ খানের সাথে পরিচয় করে আসব–
না–আমি জোরে মাথা নেড়ে বললাম, তুই কথা দিয়েছিস জয়নালের কথা কাউকে বলবি না, তুই কিছুতেই যেতে পারবি না। কিছুতেই না।
আমি জয়নালের কথা বলব না, একটা কথাও বলব না। এই বুক ছুঁয়ে বলছি।
তাহলে কি বলবি?
কিছু বলব না। শুধু জিজ্ঞেস করব দেশের উপকার করার জন্যে কি করা যায় সেটা নিয়ে কি ভাবেন? তখন নিজে থেকেই হয়তো বলবেন।
আর যদি না বলেন?
না বললে নাই, তাহলে অন্য কাউকে নিয়ে লিখতে হবে।
ব্যাপারটা আমার ঠিক পছন্দ হল না, কিন্তু সেটা নিয়ে ঠিক কি করা যায় বুঝতে পারলাম না।
.
জারুল চৌধুরীর বাসায় গিয়ে তাকে খুঁজে পেলাম না। নিচে নেই, উপরে নেই, ভয়ে ভয়ে ঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখি, দরজা খোলা, ঘরের ভিতরে কেউ নেই। যখন চলে আসছিলাম তখন শুনি, কোথা থেকে জানি ঠকঠক করে শব্দ হচ্ছে। শব্দ যেদিক থেকে আসছে সেদিকে গিয়েও কিছু খুঁজে পেলাম না। যখন চলে আসছিলাম, হঠাৎ শুনি জারুল চৌধুরীর গলা, চিৎকার করে ডাকছেন, এই যে সলীল! মুনীর!
আমরা এদিক সেদিক তাকিয়ে তাঁকে খুঁজে পেলাম না। কোথা থেকে বলছেন?
এই যে আমি এখানে। উপরে!
আমি আর সলীল অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকালাম, দেখি, দূরে বিশাল একটা গাছের ডাল পাতার ফাঁক থেকে জারুল চৌধুরী আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন। আমি আর সলীল এগিয়ে গেলাম, কাছে গিয়ে দেখি, গাছের মোটামোটা তিনটা ডালের মাঝখানে একটা ছোট ঘর তৈরি করা হচ্ছে। ঘরটি এখনো শেষ হয়নি, দু পাশের দেয়াল আর উপরের ছাদ এখনো বাকি। কিন্তু এটা যে একটা ঘর তাতে কোন সন্দেহ নেই। জারুল চৌধুরীর মাথায় লাল গামছাটি বাধা, হাতে একটা হাতুড়ি, সেটা দিয়ে নিশ্চয়ই কোথাও পেরেক ঠুকছিলেন। আমরা বিস্ময়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম। বইপত্রে কোথাও কোথাও দেখেছি মানুষ গাছের উপর ঘর তৈরি করে, তাই বলে সত্যি সত্যি?
সলীল ফিসফিস করে বলল, হুবহু সুইস ফেমিলি রকিন্সন! মনে আছে?
আমি মাথা নাড়লাম, জারুল চৌধুরী গাছের উপর থেকে বললেন, তারপর মানিকজোড়, কি মনে করে?
সলীল তখনো কথা বলতে পারছিল না, কোন মতে একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে চাপা গলায় বলল, কি সুন্দর! আহা কি সুন্দর!
জারুল চৌধুরী হো হো করে হেসে বললেন, উপরে আসবে?
আমরা দুজন জোরে জোরে মাথা নাড়লাম। আগে ধারণা ছিল মানুষটি পাগল, কিন্তু যে গাছের উপর এত সুন্দর ঘর তৈরি করতে পারে সে আর যাই হোক পাগল না। আর যদি পাগল হয়েই থাকে তাহলে পৃথিবীতে এরকম পাগলেরই দরকার।
আমরা ডাল বেয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, জারুল চৌধুরী মাথা নেড়ে বললেন, দাঁড়াও, দড়ির মইটা নামিয়ে দিই।
জারুল চৌধুরী উপর থেকে একটা দড়ির মই নামিয়ে দিলেন। দুটি মোটা দড়ির মাঝখানে বাঁশের শক্ত কঞ্চি বেঁধে মই তৈরি করা হয়েছে। এত চমৎকার যে আমরা একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মই দিয়ে প্রথমে আমি, আমার পিছনে সলীল উঠে এল। উপরে খোলামেলা একটা ঘর তৈরি হচ্ছে, শক্ত কাঠের মেঝে, চারপাশে দেয়াল। একদিকে একটা জানালা, ছাদ তৈরি করার জন্যে কাঠ পাতা হয়েছে, ঢেকে দেয়া বাকি।
জারুল চৌধুরী চশমার ওপর দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, কি মনে হয় তোমাদের? আমার নতুন বাসা–
আপনার বাসা? আপনি এখানে থাকবেন?
হুম! জারুল চৌধুরী এক ধরনের রহস্যের মত ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বললেন, যখন ছোট ছিলাম তখন খুব শখ ছিল গাছের উপর একটা ঘর তৈরি করব। ছেলেবেলায় আর তৈরি করতে পারিনি। এখন এত সময়, ভাবলাম গাছের উপর ঘর একটা তৈরি করে ফেলি। পরে আফসোস রয়ে যাবে, তাহলে মরে আবার ভূত হয়ে ফিরে আসতে হবে! কি, ভাল হচ্ছে না?
আমরা এত মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম যে, একেবারে কোন কথাই বলতে পারছিলাম না।
জারুল চৌধুরী হাত দিয়ে দেখালেন, এই যে এখানে হবে আরেকটা জানালা। আর এই যে ছাদ। দড়ির একটা বিছানা থাকবে, শুয়ে শুয়ে বই পড়ব। রাত্রে ঘুমাতে চাইলে স্লিপিং ব্যাগ।
স্লিপিং ব্যাগ?
হ্যাঁ, স্লিপিং ব্যাগ জান তো কি?
সলীল মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, জানি। বইয়ে পড়েছি। ব্যাগের মত থাকে, ভিতরে ঘুমায়। ঠাণ্ডা লাগে না।
হ্যাঁ, আর এখানে একটা ছোট শেলফের মত হবে, সেখানে বইপত্র, শুকনো খাবার।
আমরা হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, জারুল চৌধুরীর ডান হাতের তালুতে একটা ব্যাণ্ডেজ, মনে হয় কোনভাবে কেটে গিয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার হাতে কি হয়েছে?
জারুল চোধুরী কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন, মাথা নেড়ে বললেন, আর বল না, গত সপ্তাহে একটা ঢাউস ঘুড়ি তৈরি করে উড়াচ্ছি। সূতায় মাঞ্জা দিয়েছি আচ্ছা মত, সূতা তো নয়, একেবারে ধারালো চাকু! বেশ ভালই উড়ছিল, চারটা ঘুড়ি কেটে দিলাম, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই গোত্তা খেল নিচের দিকে, প্রথমে সূতাটা একটু ঢিল দিয়ে যেই ছেড়েছি হঠাৎ সঁই সাঁই করে উঠতে লাগল, হাত দিয়ে ধরতে গেলাম, মাঞ্জা দেয়া। সূতায় হাত কেটে একেবারে রক্তারক্তি!
সলীল বলল, ইশ!
বুড়ো মানুষদের বাচ্চা হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। যখন বাচ্চা ছিলাম তখন কাজগুলি কি সহজ ছিল, এখন যতই দিন যাচ্ছে ততই কঠিন হয়ে যাচ্ছে!