মাসুদ ভাই থতমত খেয়ে গেল, বলল, ইয়ে মনে হয় ওই সময় মানুষ ওইভাবে গোসল করত–
মামুন বলল, খুবই বেশরম মনে হয়।
এত বড় একজন বৈজ্ঞানিককে বেশরম বলায় মাসুদ ভাই মনে হলো একটু রাগ হলো কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না, আবার আর্কিমিডিসের সূত্র দিয়ে সোনার মুকুটের খাদ বের করা হয় সেটা বোঝাতে লাগল। আমরা। কিছুই বুঝলাম না, মাসুদ ভাই রাজনীতির কথা, দেশের কথা খুব ভালো বোঝাতে পারে কিন্তু বিজ্ঞান কিছুই বোঝাতে পারে না। তখন আমি শোনা বন্ধ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। লেখাপড়াটা আমার জন্য না। নানির যন্ত্রণায় স্কুলে আসতে হয়–এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। মনে হয় একদিন বন্ধ করে দিতে হবে।
কতক্ষণ বাইরে তাকিয়ে ছিলাম কে জানে হঠাৎ করে চমকে উঠলাম, শুনলাম মাসুদ ভাই গলা উঁচু করে বলছে, এই যে, এই যে ছেলে–
আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি মাসুদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, জিজ্ঞেস করল, কী নাম তোমার?
রঞ্জু।
তা রঞ্জু, তুমি এত মনোযোগ দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছ। ব্যাপারটা কী? আমি ক্লাসে পড়াচ্ছি–
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম, বলতে তো পারি না যে, আপনি কী পড়াচ্ছেন তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝি না।
মাসুদ ভাই বলল, দেখে মনে হচ্ছিল খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছিলে। কী ভাবছ?
আমি আসলে কিছুই ভাবছিলাম না। সব সময়েই কিছু একটা ভাবতে হবে কে বলেছে?
মাসুদ ভাই বলল, বলো, কী ভাবছিলে?
তখন আমার মাথায় মাসুদ ভাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা বুদ্ধি এল। বললাম, দেশের অবস্থা খুব খারাপ, কী গোলমাল হয় সেটা চিন্তা করে ভয় লাগছে!
পুরোপুরি মিথ্যা কথা কিন্তু আমার কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। মাসুদ ভাই একেবারে আমার কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আরে রঞ্জু, তোমার ভয় পাওয়ার কী আছে? এটা আমাদের দেশ না? এখানে কে কী করবে?
আমি কিছু বললাম না, শুধু দেশের চিন্তায় খুবই কাহিল হয়ে আছি এ রকম একটা ভাব করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করল, এইটা কী মাস?
মাঘ মাস।
ইংরেজি?
গ্রামের মানুষ আমরা বাংলা মাস দিয়েই কাজ চালিয়ে দিই, তাই ইংরেজি মাসটা বলতে পারলাম না। মাসুদ ভাই বলল, ফেব্রুয়ারি। এমনভাবে বলল যে ফেব্রুয়ারি মাসটা খুবই সম্মানিত একজন মানুষ! এটাকে রীতিমতো পা ছুঁয়ে সালাম করতে হবে।
ফেব্রুয়ারি মাসটা কিসের মাস জানো?
মেয়েদের ভেতরে কে একজন চিকন গলায় বলল, জানি। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম নীলিমা। নীলিমা মনে হয় সবকিছু জানে।
মাসুদ ভাই মনে হলো খুবই উৎসাহ পেল, বলল, বলো দেখি।
নীলিমা বলল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষার মাস।
মাসুদ ভাই উৎসাহে হাতে কিল দিয়ে বলল, ভেরি গুড। শুধু একজন জানলে হবে না। সবাইকে জানতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে শহীদ দিবস। ঢাকা শহরে বিশাল শহীদ মিনার আছে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে লক্ষ লক্ষ মানুষ খালি পায়ে ফুল দিতে যায়।
আমরা প্রত্যেক দিনই খালি পায়ে স্কুলে আসি তাই খালি পায়ে প্রভাতফেরি করে বাড়তি কী লাভ ধরতে পারলাম না। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করলাম না, মাসুদ ভাই যত উৎসাহ নিয়ে বিজ্ঞান বোঝায় তার থেকে অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস এগুলো বোঝায়।
মাসুদ ভাই উৎসাহে টগবগ করতে করতে বলল, এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসটা অন্য রকম। সারা দেশে একটা উত্তেজনা! ঢাকা শহরে অন্য রকম অবস্থা, মানুষের মাঝে সাংঘাতিক রকম উৎসাহ-উদ্দীপনা। এই ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একটা জবাব দেওয়া হবে–কথা বলতে বলতে হঠাৎ মাসুদ ভাই থেমে গেল, জানালার কাছে এসে বাইরে তাকাল, মাথা ঘুরিয়ে কী যেন দেখে আবার ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাদের সমস্যাটা কী জানো?
আমাদের অনেক সমস্যা, মাসুদ ভাই কোনটার কথা বলছে বুঝতে পারলাম না। মাসুদ ভাই আমাদের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না, বলল, তোমাদের সমস্যা হচ্ছে তোমাদের স্কুলে কোনো শহীদ মিনার নাই।
আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম, শহীদ মিনার?
হ্যাঁ। প্রত্যেকটা স্কুলে একটা শহীদ মিনার থাকতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি করে সেখানে ফুল দিতে হয়।
একজন জিজ্ঞেস করল, শহীদ মিনার কী রকম হয়?
তোমরা কখনো শহীদ মিনার দেখ নাই?
আমরা মাথা নাড়লাম, না।
মাসুদ ভাই চক নিয়ে বোর্ডের কাছে শহীদ মিনার আঁকতে গেল। তারপর হঠাৎ করে থেমে গেল, ক্লাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা এই স্কুলে একটা শহীদ মিনার বানাব।
লেখাপড়া ছাড়া অন্য সব কাজে আমাদের উৎসাহের শেষ নাই। তাই আমরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।
.
০৪.
আমি আর মামুন তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন ফালতু মতি আমাদের পেছন থেকে ডাকল, হেই! হেই পোলাপান।
আমরা মোটেও পোলাপান না কিন্তু ফালতু মতির কথাবার্তা এই রকম। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম, তখন মতি তার বাহারি লুঙিটার কোনা ধরে খানিকটা উপরে তুলে হেঁটে হেঁটে আমাদের কাছে এল, ঠোঁটের এক পাশটা উপরে তুলে মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করল, কই যাস?
আমি বললাম, স্কুলে।
আজকে আবার কিসের স্কুল। আজকে শুক্রবার না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমরা স্কুলে শহীদ মিনার বানাচ্ছি তো–