জোঁকটাকে পা দিয়ে পিষে ফেলে আমরা লতিফা বুবুকে জিজ্ঞেস করতাম, তুমি জোঁককে এত ভয় পাও কেন?
লতিফা বুবু বলত, জোঁক খুব খারাপ। খুব ভয়ংকর।
কেন।
একবার হয়েছে কী, একটা মেয়ে পুকুরে সাঁতরাতে গেছে—
তারপর।
লতিফা বুবু হঠাৎ থেমে গিয়ে বলত, না। বলা যাবে না।
কেন বলা যাবে না।
লতিফা বুবু রেগে চুলের ঝুঁটি টেনে বলত, আমি বলেছি বলা যাবে, সেই জন্য বলা যাবে না।
সেই গল্প আর কখনো শোনা হয় নাই। সেই লতিফা বুবু এখন অন্য রকম হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য। তার পাশে দাঁড়িয়ে আমরা বলার কিছু খুঁজে পাই না!
.
পরদিন আমি আর মামুন স্কুলের লাইব্রেরিতে লতিফা বুবুর জন্য বই আনতে ঢুকলাম। কাজটা অবশ্য খুব সহজ হলো না। স্কুলের লাইব্রেরি ঘরটা বেশির ভাগ সময় তালা মারা থাকে। স্কুলের লাইব্রেরিয়ান নাই। চিকা স্যার (চেহারার মাঝে একটা চিকা ভাব আছে সেই জন্য নাম চিকা স্যার) দায়িত্বে থাকেন। চিকা স্যার অবশ্যি মানুষটা ভালো, লাইব্রেরি থেকে বই নিতে চাই শুনে খুশিই হলেন। দপ্তরি রসময়ের হাতে চাবি দিয়ে আমাদের জন্য লাইব্রেরি খুলে দিতে বললেন।
লাইব্রেরির ভেতরে ধুলা আর মাকড়সার জাল। আলমারি বোঝাই বই, বইগুলো বাঁধাই করা। আমরা খুঁজে খুঁজে দুইটা বই বের করলাম, একটা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র, আরেকটা ভেষজ উদ্ভিদের গুণাবলির ওপর। বইয়ের ভেতরে কী আছে তার চাইতে বেশি গুরুত্ব দিলাম বইয়ের সাইজের ওপর। মোটা বই হলে লতিফা বুবু অনেক দিন পড়তে পারবে।
বইগুলো নিয়ে ক্লাসে আসার পর একটা সমস্যা হয়ে গেল, সবাই জানতে চায় এত মোটা বই দিয়ে আমরা কী করব। মানুষ বই পড়ে, কাজেই খুবই সোজা উত্তর হচ্ছে যে আমরা বইগুলো পড়ব, কিন্ত সমস্যা হচ্ছে সবাই জানে। আমরা বই পড়ার মানুষ না, তাও এ রকম মোটা বাঁধাই করা বই! বইগুলো নিশ্চয়ই কেউ পড়বে কিন্তু কে পড়বে, সেটাই সবাই জানতে চাইছে। লতিফা বুবুর নামটা বলা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিলাম না।
ক্লাস শুরু হবার পর মাসুদ ভাই এসেও আমাদের সামনে এই মোটা বই দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি এই মোটা বই পড়বে? বাহ্। কী চমৎকার। ভেরি গুড। বই পড়া খুব ভালো অভ্যাস। কী বই দেখি?
আমি মাথা চুলকে বইটা মাসুদ ভাইয়ের হাতে দিলাম। মাসুদ ভাই বইটা খুলে আরো অবাক হলো, বঙ্কিম রচনাবলি। তুমি বঙ্কিমের বই পড়ো। কী অসাধারণ।
ক্লাসের সব ছেলে তখন একসাথে আপত্তি করল, রীতিমতো চিৎকার করে বলল, না, মাসুদ ভাই। রঞ্জু কোনো বই পড়ে না–
মাসুদ ভাই একটু অবাক হয়ে বলল, বই পড়ো না? তাহলে এত মোটা বই কেন নিচ্ছ?
আমাকে তখন সত্যি কথাটা বলতে হলো। আমাদের লতিফা বুবুর খুব লেখাপড়ার শখ, এখন তার স্কুল বন্ধ। তাই বাড়িতে বসে থাকে, তার জন্য এই বই। লতিফা বুবুর কথা শুনে মাসুদ ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, একটা ছেলে থেকে একটা মেয়ের লেখাপড়া করা বেশি দরকার। আমরা এমন একটা সিস্টেম করে রেখেছি যে মেয়েরা লেখাপড়া করতে পারে না।
মাসুদ ভাই এমনভাবে আমাদের দিকে তাকাল যে মনে হলো দোষটা আমাদের। তার কথাটা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করলাম না, আমার নানি লেখাপড়া জানে না, তার যন্ত্রণায় আমার জীবন শেষ। নানি যদি লেখাপড়া জানত তাহলে কী উপায় ছিল?
মাসুদ ভাই বলল, তোমাদের লতিফা বুবুর জন্যও মনে হয় বইগুলো একটু কঠিন হয়ে যাবে! দরকার শরৎচন্দ্রের বই, তা না হলে তারাশংকর কিংবা বিভূতিভূষণের বই। আরো সোজা হবে আশাপূর্ণা দেবী কিংবা শংকরের–হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পড়ে গেল, তখন চোখ বড় বড় করে বলল, আমি আশাপূর্ণা দেবীর একটা বই পড়ছি। নাম হচ্ছে প্রথম প্রতিশ্রুতি! বইটা প্রায় শেষ, আর কয়েক পৃষ্ঠা বাকি। আমি নিয়ে আসব, তোমাদের লতিফা বুবুকে পড়তে দিতে পারো। পড়ে আবার ফেরত দিতে হবে কিন্তু।
আমি বললাম, ফেরত দেবে মাসুদ ভাই। লতিফা বুবুর কাছ থেকে আমি বই ফেরত এনে আপনাকে দেব।
মামুন তখন আমার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে চোখ টিপে বলল, বলেছিলাম না।
কী বলেছিলি?
মাসুদ ভাই এই গ্রামের জামাই। এখনই বই দেওয়া-নেওয়া হচ্ছে। তারপর কী দেওয়া-নেওয়া হবে বুঝলি না?
আমি আসলেই কিছু বুঝলাম না। মামুনের অনেক কথাই আমি বুঝি না।
মাসুদ ভাই তখন আমাদের বিজ্ঞান পড়াতে শুরু করল। আর্কিমিডিসের সূত্র দিয়ে আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করল কেন লোহা ডুবে যায় কিন্তু লোহার তৈরি জাহাজ ভেসে থাকে। খুবই উৎসাহ নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু আমরা কিছুই বুঝলাম না। মাসুদ ভাই একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করতে লাগল, বুঝেছ তো? আমরা কিছুই বুঝতে পারি নাই কিন্তু খুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলাম যে সব বুঝে ফেলেছি। মাসুদ ভাই তখন আর্কিমিডিসের গল্পটা বলল, রাজার জন্য সোনার মুকুট তৈরি হয়েছে তার মাঝে খাদ আছে কি না সেটা আর্কিমিডিসকে বের করে দিতে হবে। আর্কিমিডিস সমস্যাটা চিন্তা করতে করতে গোসল করার জন্য পানির গামলায় নেমেছে, তখন হঠাৎ করে সমাধানটা মাথায় এসে গেছে। ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে ন্যাংটো হয়ে দৌড়াতে শুরু করেছে–
গল্পের এই জায়গায় মামুন মাসুদ ভাইকে থামাল, জিজ্ঞেস করল, মাসুদ ভাই, ন্যাংটো হয়ে কেন?