.
তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। মাসুদ ভাই তার কলেজে লেখাপড়া করতে ফিরে গেছে। লতিফা বুবুর বিয়ে হয়ে গেছে–ছেলেটা স্কুলের মাস্টার। আমাদের খুব ইচ্ছা ছিল লতিফা বুবুর সাথে মাসুদ ভাইয়ের বিয়ে হোক, হয় নাই। মতি রাজাকার আর তার বাবা লতিফ চেয়ারম্যান জেলে। তাদের বাড়িটাতে এখন কেউ থাকে না। কেমন করে থাকবে? গ্রামের মানুষ বাড়িটা জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আমি অনেক দিন অপেক্ষা করেছিলাম নীলিমাদের ফিরে আসার জন্য। নীলিমারা আর ফিরে আসেনি। তাদের কোনো খবরও জানি না। তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে, তাও জানি না। যখন দেখলাম নীলিমারা ফিরে আসছে না, ফিরে আসবে বলেও মনে হয় না, তখন একদিন আমি তাদের বাড়ির তুলসীতলা খুঁড়ে নীলিমা কী পুঁতে রেখেছে সেটা বের করলাম। একটা বাঁধানো খাতা। খাতাটা আসলে একটা ডায়েরির মতন। সেখানে কত রকম কথা, গানের লাইন, কবিতা, খবরের কাগজ থেকে কেটে রাখা ছবি, শুকনো ফুলের পাপড়ি, গাছের পাতা। দেখেই বোঝা যায়, এটা নীলিমার খুব নিজস্ব একটা জিনিস কিন্তু সাথে করে নিতে পারেনি। যখন কেউ দেশ ছেড়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায় তখন কেউ এগুলো সাথে নেয় না। আমি খাতাটা বাঁচিয়ে রেখেছি, যদি কোনো দিন নীলিমার সাথে দেখা হয় তাকে ফিরিয়ে দেব।
অবস্থা যখন একটু স্বাভাবিক হয়েছে তখন একদিন ডোরা তার আম্মু আর বোনের সাথে শহরে চলে গেল। আমার মনে আছে, ঠিক বিদায় নেবার আগে আমরা যখন কালীগাংয়ের ঘাটে দাঁড়িয়ে আছি তখন ডোরা আমাকে ফিসফিস করে বলল, রঞ্জু, তোকে একটা কথা বলি?
আমি বললাম, কী কথা?
যখন আমি তোকে ছেড়ে চলে যাব তখন কিন্তু তুই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকবি না। তাহলে তোকে দেখলেই আমার চোখে পানি চলে আসবে। আমার খুব অল্পতে চোখে পানি চলে আসে।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
ঠিক যখন ডোরা আলাউদ্দিন চাচার নৌকাতে উঠতে যাচ্ছে আমি তখন জোর করে মুখটা হাসি হাসি করে রাখলাম। ডোরা যে শুধু তার মুখটা হাসি হাসি করে রাখল তা না, শব্দ করে হাসতে শুরু করল যেন খুবই মজার একটা ব্যাপার হচ্ছে।
হাসতে হাসতে একসময় ডোরার চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি পড়তে লাগল। ডোরা এমন ভান করল যেন সে জানেই না যে তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, রঞ্জু, তুই আমাকে চিঠি লিখবি।
আমি বললাম, লিখব।
ডোরা বলল, লম্বা লম্বা চিঠি লিখবি।
লিখব।
কাঁকনডুবির সবার খবর দিবি।
দিব।
সত্যি দিবি তো?
আমি বললাম, দিব। সত্যি দিব।
তখন ডোরা ঘুরে আলাউদ্দিন চাচার নৌকায় উঠে গেল। আমি শেষ পর্যন্ত হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম, চেষ্টা করলাম যেন চোখ থেকে পানি বের না হয়। যখন ডোরা, তার আম্মু আর বোনকে নিয়ে নৌকাটা কালীগাংয়ের ঢেউয়ে দুলতে দুলতে দূরে সরে যেতে লাগল, আস্তে আস্তে ছোট হয়ে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল তখন আমার চোখ থেকে পানি বের হয়ে এল।
আশপাশে কেউ নেই তাই আমি চোখ মোছারও চেষ্টা করলাম না।
কী হবে চোখের পানি মুছে?